শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

কাশেম রাজাকার হত্যার পর গোদনাইলে রাজাকারদের অত্যাচার বন্ধ হয়েছিল

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সাউদ

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০২২  


আজ থেকে শুরু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একাত্তরে এই ডিসেম্বর মাসেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান যুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তায়’ একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হবে। আজ ছাপা হলো সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সাউদের একটি অপারেশনের কাহিনী।

 

 

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক অপারশন করেছি। কিন্তু একটি অপারেশনের স্মৃতি আমি কখনোই ভুলতে পারিনা। অপারেশনটি ছিল আদমজী এমডব্লিউ স্কুলের সামনে তখনকার দুর্ধর্ষ রাজাকার ‘কাইশ্যা চোরা রাজাকার’ (কাশেম চোর) কে হত্যা করা।

 

 

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এ অপারেশনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই অপারেশনের পর আমাদের গোদনাইল, আদমজী, সিদ্দিরগঞ্জ এলাকায় রাজকারদের অত্যাচার অনেক কমে গিয়েছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়া অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।

 

 

একাত্তর সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশের পর আমি আরো কয়েকজনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের  গোদনাইল গ্রাম থেকে ভারতের আগরতলায় চলে যাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। সেখান থেকে ফিরে এসে এলাকায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশন শুরু করি।

 

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এলাকায় কাশেম নামে এক চোর ছিল যাকে সবাই ‘কাইশ্যা চোরা’ বলতো। সেই কাশেম পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে রাজাকার হয়ে এলাকায় অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। সে আদমজীর বিহারীদের নিয়ে এলাকায় নানান ভাবে একটি ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছিল।

 

 

সে পাকিস্তানিদের সাথে আদমজী মিলের ভিতরে রাজাকার ক্যাম্পে থাকতো। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অন্য রাজাকারদের নিয়ে এলাকায় চাষের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যখন তখন বিভিন্ন লোকের বাড়িতে গিয়ে হানা দেয়া লুটপাট করা ছিল তার কাজ। সে এলাকার লোকজনকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিত।

 

 

এলাকার বিশিষ্ট ট্যাংকলরী ব্যবসায়ী আবদুল জাব্বারকে পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরিয়ে দেয়। এছাড়ারও মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মোল্লাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এ জন্য আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ছিলাম তারা প্রকাশ্যে চলাচল করতে পারতাম না এবং আমাদের বাড়িঘরে যেকোনো সময় গিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার একটি আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।

 

 

একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এই রাজাকারকে প্রতিহত করতে না পারলে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশন করা কঠিন হয়ে পড়বে।  কাশেম রাজাকার আদমজী মিলের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এমডব্লিউ স্কুলের কাছে বাজার করতে আসতো। সেখানে তখন একটি বাজার বসতো কারণ বিহারীদের অত্যাচারের কারণে সোনা মিয়া বাজারে তখন কোন বাজার বসতে পারত না।

 

 

কাশেম রাজাকার সেই বাজারে মাঝে মাঝে আসতো বাজার করতে। একদিন আমি এবং আমাদের দলের আরেক মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম কেতা মিলে কাশেম রাজাকারকে হত্যার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা দুই তিন দিন তাকে ফলো করেও বাজারে পাইনি।

 

 

প্রথম দিন আমরা অস্ত্র নিয়ে আসে পাশে ঘোরাফেরা করি, কিন্তু সেই দিন সে বাজার করতে আসেনি। এভাবে  দুইদিন ব্যর্থ হয়ে একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। এভাবে কয়েকদিন চেষ্টার পর একদিন হঠাৎ তাকে পেয়ে গেলাম। আমরা সকালেই আমাদের  গোদনাইল এলাকা থেকে দুটি স্টেনগান নিয়ে আমি ও তাজুল ইসলাম চাদর গায়ে দিয়ে চাদরে স্টেনগান ঢেকে এম ডব্লিউ স্কুলের সামনে গিয়ে ওত পেতে থাকলাম।

 

 

ঠিক সেদিন কাশেম রাজাকার আদমজী মিল থেকে বেরিয়ে এসে বাজার করতে আসে। সে আমাদের দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমরা কোন সুযোগ না দিয়ে চাদর খুলে স্টেনগান বের করে তার দিকে ব্রাশফায়ার করলাম।

 

 

কাশেম রাজাকারের শরীরে গুলি লাগার পরপরই সে লুটিয়ে পড়লো রাস্তার উপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার শরীর নিথর হয়ে পড়ে রইলো। রক্তে ভেসে গেল রাস্তা। গুলির শব্দ শুনে বাজারের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে যেতে শুরু করলো। আমরা তাকিয়ে দেখি আশেপাশে কেউ নেই।

 

 

আমরা স্টেনগান আবার চাদরের ভিতরে লুকিয়ে পশ্চিমদিকে হেঁটে স্কুলের পশ্চিম দিকে রাস্তা ধরে গ্রামের দিকে হাটতে থাকি। পরে জালকুড়ি গ্রামে চলে যাই।আমরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি আর্মিরা এসে অত্যাচার করবে এই ভয়ে-আতঙ্কে এলাকার সব লোক এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

 

 

কাশেম রাজাকারকে হত্যার পরে এ এলাকায় আর কোন রাজাকার সাহস পায়নি কোনো বাড়িঘরে গিয়ে অত্যাচার করতে বা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নিতে। আমরা এই অপারেশন করার পর অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম।

 

 

তারপর এলাকায় এক ধরনের শান্তি ফিরে এসেছিল কারণ আর কোন রাজাকার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অত্যাচার করা, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য খোঁজখবর নেয়ার সাহস পায়নি। আমরা এরপর আরো কিছু অপারেশন করেছিলাম কিন্তু সেই সময় কাশেম রাজাকারকে হত্যা করার অপারেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর