রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪   ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

কৌশলে মাস চলে মধ্যবিত্তের

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

 

# পারিবারিক অশান্তি বাড়ছে
# অভাবে কলেজে ভর্তি না হতে পেরে আত্মহত্যা

 

 

দিনের পরে দিন বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের বাজার। দিনমজুর থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তদের এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করা দুঃসাধ্য হয়ে পরেছে। যে হারে দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়ছে তাতে মানুষের খেয়ে বাঁচা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সচেতন মহলের মতে বাজার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের মধ্যে জীবন টেকানোর লড়াইয়ে পার্থক্য নেই বললেই চলে। আবার অভাবের তাড়নায় পড়ে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হয়ে গৃহবধু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই ভাবে জিনিস পত্রের দাম বাড়তে থাকলে মানুষের জীবন ধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পরবে।

 

খোজঁ নিয়ে জানাযায়, দিনমজুর গরিবের ভরসা ব্রয়লার মুরগি দাম বাড়তে বাড়তে এখন ডাবল সেঞ্চুরিতে চলে গেছে। ১০ বছর আগে যেই ডিমের হালি ছিল ২০ টাকা সেই ডিম এখন ৪৫ টাকা হালি হয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ১শ’ ৫০ টাকা থেকে হাঠৎ করে ৩০ টাকা বেড়ে গত শুক্রবার তা ১শ’ ৮০ টাকা হয়েছে। তাই মানুষ জন বলছে গরিবের খাদ্যতে ভরসায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের হানা পরেছে। দণন দশক আগে মানুষ সাড়ে ৩শ’ টাকায় গুরুর মাংশ কিনে খেত। এখন তা বেড়ে সাতশ টাকা থেকে সাড়ে সাতশ টাকা হয়েছে। কিন্তু দিনমজুরদের পক্ষে তা মাসে জোটে না। কেননা নুন আনতে পান্থা ফুরাতে হয় তাদের।

 

তার মাঝে আবার মরার উপর খড়ারর ঘা হয়ে যাচ্ছে সম্প্রতি গ্যাস, বিদ্যুৎের দাম বৃদ্ধি করা। যেখানে মানুষের দিন এনে দিন চলতে শরীরের ঘাম ঝরে যায়। সেখানে গ্যাস বিদ্যুৎের দাম বাড়লে মানুষের জীবন ধারণ করা আরও কষ্টকর হয়ে যাবে বলে মনে করে সচেতন মহল। এদিকে ২০২০ ও ২০২১ সনে করোনার কারণে অনেক স্বচ্ছল পরিবার অস্বচ্ছল হয়ে পড়ে। যারা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারে নাই। এই করোনার সময় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্তে পরিনত হয়। অনেকের জমানো শেষ সম্বল সঞ্চয় ভেঙ্গে জীবন ধারনের জন্য খরচ করে ফেলেন।  

 

এছাড়া করোনার কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবন যাপন করা আরও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যবিত্তের সংকট ‘সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়’। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, দৈনন্দিন বাজার খরচ কিছুটা সাশ্রয়ী করতে লোকলজ্জার ভয় ও অস্বস্তি নিয়েই টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। আর নিম্ন আয়ের মানুষেরা বলছেন, ওএমএসের লাইনই এখন তাদের ভরসা। মাস চালাতে টালমাটাল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। দিনমজুরদের কথা না বললেই চলে। কিন্তু ঠিক নিম্নবিত্তের কাতারে নিজেকে ভাবতে চান না এমন মানুষ সহজে লাইনে দাঁড়াতে পারেন না বলে জানান টিসিবির পণ্যপ্রত্যাশী।

 

সরেজমিন কৌশলে জেনে নেওয়া যায়, শহরের দিগু বাবু বাজার, মাসদাইর বাজার, পাইক পাড়া বৌ বাজার এলাকায় বাজার করতে আসা ১০ জনের মধ্যে সাত জন জানান, আগে মাছ-মাংস একসঙ্গে হলেও এখন গেস্ট না হলে তেমন রান্না এড়িয়ে যান। খাবারের মেন্যু আগের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছেন। বিকালের নাস্তায় বাইরে থেকে কিছু না এনে ঘরেই বানানোর চেষ্টা করেন। বাচ্চাদের দূরের স্কুল থেকে কাছের স্কুলে এনেছেন স্কুলের বেতন ও ভাড়া বাঁচানোর জন্য।

 

শনিবার দুপরে নগরীর মন্ডলপাড়া চা খেতে খেতে কথা হয় মোস্তফা নামের এক রিক্সা চালকের সাথে। তিনিও কাজের ফাঁকে চা খেতে বসেন একটি দোকানে। এসময় আলাপচারিতার এক ফাঁকে তিনি যুগের চিন্তার প্রতিবেদককে বলেন, আমার দুটি সন্তান রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল রসুলপুরে। সেখানকার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়ে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে। আর ছেলে পঞ্চম শ্রেনীতে। তাদের বইয়ের গাইড কিনবো কিভাবে তা বুঝতে পারছি না। পায়ের রিকশা চালাই বলে অনেকে রিকশায় উঠতে চায় না। কারণ ব্যাটারি চালিত রিকশায় সবাই উঠে। আবার ব্যাটারি চালিত রিকশা চালালে পুলিশ আটকায় দেয়। তখন হাজার টাকা দিয়ে চলে আসতে হয়। এছাড়া গাইডের দাম এবার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যে কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা করাবো নাকি পরিবারের খরচ চালাবো সেই টেনশনে আছি।

 

কতভাবে টিকে থাকা যায় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন ইয়াসিন সরকার। তিনি মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতন পান। জিনিসপত্রের দাম, বাড়ি ভাড়া, তার মাঝে আবার নিত্যপণ্যের বাজার এতই বেড়েছে যে তার একার আয়ে ৪ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। বাড়ি ভাড়া ছয় হাজার টাকা। বাড়িভাড়া বাঁচিয়ে কোনোমতে কিছু টাকা দিয়ে সংসার চালান। সমাজে চলতে, অফিসে প্রতিদিনের সামাজিকতাসহ কিছু খরচ চালিয়ে কোনোভাবেই সৎ উপায়ে জীবনযাপন সম্ভব না। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে ফেরার পরে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে যায়। এটা নাই সেটা নাই করে জীবন চালাতে গিয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলতে ভুলেই গেছি।’

 

গত শনিবার অফিস থেকে ফেরার পথে শহরের দিগু বাবু বাজারে মুরগি কিনতে নামেন সাদিয়া। বাজারের হালচাল নিয়ে তিনি বলেন, ‘যারাই নিজেদের সীমিত আয়ে সম্মান বাঁচিয়ে চলতে চান, তাদের অবস্থা ভালো বলার কোনও সুযোগ নেই। বাসায় বাবা মা, বোনদের দুটো বাচ্চা আছে। তাদের তো পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। নদীর মাছ আগে কেনার কথা ভাবলেও এখন একদমই ছেড়ে দিয়েছি। চাষের রুই আর ব্রয়লার মুরগি কিনি। এই হচ্ছে ভালো মেন্যু। কিন্তু সেই সস্তা ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। বাসা ভাড়া দিয়ে জীবন যাপন চলা খুবই কষ্টকর হয়ে গেছে। সরকার যদি নিত্যপণ্য বাজারের দিকে একটু নজর দিত।

 

অপরদিকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার উপজেলা এলাকার গত বছর এপ্রিল মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাচঁ জনের লাশ পাওয়া যায়। তার মাঝে ৭ এপ্রিল হাইজাদী ইউনিয়নের তিলচন্দী গ্রামের মৃত মুনসুর আলীর সদ্য এস এস সি পাস করা মেয়ে মাসুমা আক্তার (১৭) কীটনাশক বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। নিহতের মা রোকসানা জানান, এস এস সি পরীক্ষায় পাস করার পর টাকা পয়সার সমস্যার কারণে তাকে কলেজে ভর্তি করা হয়নি। এ নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে অভিমানে আত্মহত্যা করে তার মেয়ে। গত বছরের ১ এপ্রিল স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে ঘরের আঁড়ার সাথে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নিপা আক্তার (২১) নামে এক গৃহবধূ।

 

সে উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের নগরজোয়ার গ্রামের বাসিন্দা আবু হানিফার স্ত্রী। স্বামীর সাথে অভিমান করে সে আত্মহত্যা করেছে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে। ২৯ মার্চ দুপুরে বগাদী গ্রামে সুফিয়া আক্তার (৩৫) নামে এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সুফিয়া এবং তার স্বামী সোহেল ওই এলাকায় ভাড়া থেকে বুনাফাইড মশারীর মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। স্বামীর সাথে অভিমান করে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে জানা গেছে। এছাড়া অন্যান্য কারনে আরও কয়েকজন আত্মহত্যা করেন।

 

অর্থনীতিবিদদের মতে, কোনও বৈষম্য সৃষ্টি হলে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়ে। মধ্যবিত্ত খাওয়া কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত জীবনযাপনের সব বিষয়ে খরচ কমানোর কৌশল অবলম্বন করে টিকে থাকতে চেষ্টা করে। কেননা, তার সামাজিক পজিশনের কারণে সে ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। ঝুঁকি নিয়ে মধ্যবিত্তের এক অংশ পরাজিত হয়ে ফেরত আসে। আরেক অংশই কিন্তু তার অবস্থান পরিবর্তন করে বিত্তশালী হওয়ার সম্ভাবনায় যায়। ফলে এই পরিস্থিতিতে তাদের ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনাটাকে জিইয়ে রাখার জন্য, যা করণীয় সেটায় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার বিষয়টি ভাবতে হবে।’

 

সমাজবিদদের মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তদের সব সমস্যা। না পারে জীবনমান টিকিয়ে রাখতে, না পারে নামতে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত প্রোটিন খেতে পারছে না। যারা হয়তো দেশি মুরগি খেতো, তারা ব্রয়লারে নামছে। কিন্তু এর চেয়ে নামবে কী করে? তাদের কাছে ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। ফলে সীমিত অর্থে চালানোর জন্য পরিবারের খরচ কমাচ্ছে। লেখাপড়ার জন্য বাড়তি কিছু করতে চেয়েও পারছে না। সার্বিকভাবে সে বিপদের মধ্যে আছে। ফলে এক ধরনের হীনম্মন্যতা জন্মাচ্ছে। সেটা সন্তানের সামনে, সমাজের সামনে। এই পরিস্থিতিতে তাদের মানসিকতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

 

এছাড়া ‘যেকোন ধরনের পরিবর্তন, সেটা দৈনন্দিন জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে এক ধরণের চাপ হয়। সেটা সামলাতে না পারলে ব্যবহারে অসঙ্গতি দেখা যায়। তখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। যেকোন না পাওয়া নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে। দ্রব্যমূল্যের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা থেকে এই দোষারোপ শুরু হতে পারে। সমাজবিদদের মতে, এই পরিস্থিতিতে থেকে বের হওয়ার জন্য দরকার পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি। পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে সেটা খেয়াল করে সামনে আরও কিসের মুখোমুখি হতে হবে, সেই ধারণা নিয়ে পরিকল্পনা করে পারস্পরিক পথ চলার পদ্ধতি নির্ধারণ করা। তাহলে হয়ত কিছুটা টিকে থাকা যেতে পারে।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর