শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১ ১৪৩১

ক্রসয়ারের ভয় দেখিয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিল পুলিশ, তোলপাড়

প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : এক যুবককে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর ওই যুবককে ৫২ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে থানায় মাদক দ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

 

যুবকের নাম মফিজ উদ্দিন মিঠু (২৫)। সে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার তেতৈইতলা গ্রামের মাছের খামারী জাফর আলীর ছেলে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গুনধর দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন, উপ-পরিদর্শক কামাল হোসেন ও সহকারী উপ-পরিদর্শক মোমেন আলম।

 

বুধবার ঘটনাটি প্রকাশ পেলে তোলপাড় শুরু হয় সর্বত্র। শুক্রবার সন্ধ্যায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে গত শুক্রবার সন্ধায় প্রথমে র‌্যাব, পরে নারায়ণগঞ্জ ডিবি পরিচয়ে মিঠুকে তুলে নিয়ে আসে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই কামাল হোসেন ও এএসআই মোমেন আলম।

 


কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করে মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার তেতৈইতলা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্ধা জাফর আলীর ছেলে মফিজ উদ্দিন মিঠু (২৫), বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সানারপাড় এলাকার সাত্তারের বাড়ীর ভাড়াটিয়া। 

 

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত শনিবার সকাল সোয়া ১১’টায় গোদনাইল এনায়েত নগর তাঁতখানা বাজারের সামনে পাকা রাস্তার উপর থেকে ৫২ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এএসআই মোমেন আলম সঙ্গীয় ফোর্সসহ গ্রেফতার করে। ধৃত মিঠুকে একই দিন মাদক মামলা দায়ের পূর্বক সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই মোঃ কামাল হোসেন আদালতে প্রেরণ করেন। 

 

এদিকে মিঠুর স্ত্রী দিলারা জানান, মিঠুকে ধরে আনার পর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা/সাড়ে ৬টার দিকে আমার স্বামী মিঠু মোবাইল ফোনে আমাকে জানায় আমি এক জায়গায় আছি। যদি আমাকে বাঁচাইতে চাও তাহলে ৭ লাখ টাকা ম্যানেজ করো। তখন আমি বলি এতো টাকা কোথা থেকে ম্যানেজ করবো। আর টাকা ম্যানেজ করে আমি কই আসবো। তখন বলে টাকা ম্যানেজ করে ফোন দাও। তারপর বলবো। একথা বলেই ফোন কেটে দেয়। 

 

কিছুক্ষন পর আমি ফোন দিয়ে বলি তুমি কই আছো, কাদের সঙ্গে আছো? সে বলে আমি ‘স্যার’দের সঙ্গে আছি। তবে আমি কই আছি জানি না, আমার চোখ বাঁধা। পরে বলে টাকা ম্যানেজ করছো? আমি বলি না, তখন বলে তাড়াতাড়ি করো। টাকা ব্যবস্থা করে ফোন দাও।

 

রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে আমার স্বামী বলে টাকার ব্যবস্থা করতে পারছো। আমি বলি পুরো টাকা ব্যবস্থা করতে পারি নাই। ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা ব্যবস্থা করতে পারছি। এটা শোনার পর ওনারে (মিঠু) থাপ্পর দিতাছে। তা মোবাইলে এ প্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছে। 

 

তখন ওনারা (পুলিশ) বলে কির তোর বৌ কি চায় না তোরে নিতে? তখন তিনি (মিঠু) কান্না করে আমাকে বলে তুমি চাওনা আমি বাসায় আসি। তুমি তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করে আসো। আমি কারণ জানতে চাইলে প্রথমে র‌্যাব পরিচয়ে পরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই কামাল হোসেন টাকা না দিলে আমার স্বামীকে ক্রস ফায়ার দিবে বলে ভয় দেখায়। আমি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা জোগার করে আমার স্বামী মিঠুর নাম্বারে ফোন দেই। 

 

এরমধ্যে আমার কাছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আর আমার ভাইয়ের কাছে ৫০ হাজার টাকা ছিল। তারপর আমি মিঠুর নাম্বারে ফোন দেই। ফোনে আমাকে টাকার জোগাড় হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আমি টাকা নিয়ে কোথায় আসবো জানতে চাই। তারা আমাকে চিটাগাং রোড আসতে বলে। আমি চিটাগাং রোড আসলে তারা আমাকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার দিকে আসতে বলে। 

 

আমি থানার সামনে গেলে এক লোক এসে বলে তুমি মিঠুর বৌ? বলার সাথে সাথে আমাদের চারজনকে এক পাসে নিয়ে যায়। এবং আমার ভাইকে আলাদ করে মারধর করে আর গালিগালাজ করে বলে মাদক ব্যবসা করো? আর আমাকে বলে তুই কি করোছ? হাউজ ওয়াইফ বলার পর বলে তোর হাজব্যান্ড কি করে জানোছ? না আমি জানি না।

 

মাদক ব্যবসায়ির বৌ, ওইগুলা চালান করো? ওই মহিলারে রাইখা সবগুলারে চালান কর? ভাইকে আবার থাপ্পড় মারে। বলে টাকা আনছোস? হ্যা আনছি। টাকা কই, কত আনছোস? ভাইয়া বলে বেশি আনতে পারি নাই। ৫০ হাজার টাকা আনতে পারছি। 

 

এটা বলাতে ভাইয়াকে আরেকটা থাপ্পড় মারে, আর অকথ্যভাষায় গালমন্দ করে বলে বাটপার। তখন এক লোক হাত টান দিয়ে নিয়ে যাবার সময় ভাইয়া বলে মিঠু কই। হ্যা আমরা টাকা আনছি। তখন বলে মিঠু আছে গাড়িতে।

 

ভাইয়াকে বলে তুমি থাকো। আমাকে বলে তুমি আসো। ভাই বলে ‘ও’ একা যাইবো না। আমিও যামু কোনো সমস্যা নাই। ও’রে যেই জায়গায় নিয়ে যান আমিও সেই জায়গায় যামু । একা ছারমু না। তখন বলে মাদার....। 

 

বেশি বুঝোস। পরে ভাইকে নিয়ে মাইক্রোতে উঠাইছে। আমার ব্যাগটা এক পাসে ছিল। ব্যাগটা একজন নিছে। গাড়ির মধ্যে অন্ধকার জায়গায় মিঠুর চোখ বাঁধা ছিল। আমারে মোবাইলের লাইট ধরতে বলে।

 

আমার ব্যাগে ছিল ২ লাখ টাকা ৪টা বান্ডেল। আর পার্সের মধ্যে খুচরা ২০ হাজার টাকা ছিল, যদি লাগে। ওই টাকাও নিয়ে গেছে ওনার হাতে। আমাদের গাড়িতে উঠানোর পর তারা ব্যাগ নিয়ে গেছে। ভাইয়ার মানিব্যাগ নিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। 

 

এরপর মিঠুকে থাপ্পড় দেয়, বলে মিথ্যাবাদি পুরা টাকা ব্যবস্থা হয় নাই। মিথ্যা কথা বলছে। কি করবি? কর, আর নয়তো পরে কি হইবো আমি জানি না। তোরে (মিঠু) তো চালান করমু না, থানায় দিমু না। তোরে ক্রসফায়ার দিয়া দিমু। তোর বৌ কি চায় বিধবা হইতে?

 

তখন আমাকে বলে এই তুই কি চাছ বিধবা হইতে, আরেকটা বিয়ে করতে? পুরো টাকা ব্যবস্থা করে আন। আমি বলি এতো টাকা ব্যবস্থা করা করা সম্ভব না। রাইত করে কইথ্থেকে ব্যবস্থা করোব। আমি এই টাকা কত জায়গা থেকে ব্যবস্থা করছি। তখন বলে তার মানে তুই জামাই চাছ না। 

 

আমাদের সামনে মিঠুর চোখ বাইন্দা ফালাইছে। আরেক লোক আইসা বলতেছে ভাই ওদের (আমার ভাইদের) লোকাপে ঢুকান। টাকা কিভাবে আসে দেখমু। ভাইয়ার পকেটে ৫০ হাজার টাকা ছিল। ভাইয়ার পকেটে দেড় হাজার টাকা ছিল, তাও নিয়ে গেছে।

 

ভাইদের যারা উপরে নিয়ে গেছে তাদের পরনে পুলিশের পোশাক ছিল না। ভাইয়া বললো একেকজনের পরনে লঙ্গী, গেঞ্জি ছিল। তারা প্রথমে র‌্যাব পরিচয় দিছে। পরে বলে আপনারা টাকা আনেন নাই। তাই র‌্যাব ডিবির কাছে দিয়ে দিসে। 

 

এরপর তারা বলে স্যাটেলেম্যান্টে আসো। আমি মুখ চেয়ে কান্না করতাছি দেখে ধমকায়। মুখ থেকে হাত টেনে নিয়ে বলে চিৎকার কর। দেখি কত জোরে চিৎকার করতে পারোছ। একটু পর এমনিই জামাই মরলে কানবি।

 

রপর বলে আচ্ছা বাদ দে, কত টাকা আনছোস, টাকা কার কাছে। এখানে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আছে। আর ৩ লাখ টাকা  ফজরের নামাজের আগে নিয়া আসবি। আর তোর স্বামীরে নিয়া যাবি। তারপর আমার মোবাইল নিয়ে দেখছে কোন রেকর্ড আছে কিনা। 

 

পরে বলতাছে যদি টাকা না নিয়া আসলে এই টাকাও নিয়া যা, আর সকালে লাশ পাঠায় দিবো বাসায়। এরমধ্যে আমারে গাড়ি থেকে নামার জন্য বলতাছে। গাড়ি থেকে নামার সময় থানার গাড়ি আসতেছে দেখে তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে স্যার থানার গাড়ি আসতাছে। এই মিঠু মাথা নিচু কর।

 

এরপর আমরা চলে আসার পর  ভোর ৫টায় আবার ফোন দিছে। মিঠু কান্নাকাটি করে বলতাছে দিলারা টাকার ব্যবস্থা হইছে? তুমি কখন আসবা। আমি বলি টাকা তো ব্যবস্থা হয় নাই। ব্যবস্থা করতাছি। তখন মিঠু বলে আমার কিছু হয়ে গেলে টাকা নিয়া আসলে কি করবা?

 

এক পর্যায়ে এক বড় ভাই বললো তোমরা এসপি অফিসে যাও ওইখানে যেয়ে বিষয়টা জানাও।  পরে ডিবি পুলিশের এসআই আব্দুল জলিল আমাকে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সামনে আসলে আমি গাড়ীটি চিনতে পারি। আমি গাড়ীর সামনে গেলে তারা আমাদের দেখে বলে টাকা কই এই মিঠু তোর বউকে টাকা বের করেতে বল। আমি বলি টাকা আমার কাছে নাই আমার ভাসুরের কাছে। পরে একেক একেক করে ওই গাড়ি সামনে যায়। 

 

তাদের মধ্যে থেকে একজন মিঠুকে বলতাছে মাদার....।  মামলা একটা খাবি। দেখিস তোর লাইফ কি হয়। ডিবি নিয়া আইছোস। আমার কাছ থেকে যে জোর করে টাকা নিছে সে বলতাছে এই মহিলা এই মহিলা আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিছি?  আমি কি তোমার কাছে কি মুক্তি পণ চাইছি? আমি তখন তারা যতবার ফোন দিছে তা লাউড স্পিকারে শুনাইছি।

 

এদিকে মামলায় উল্লেখিত আসামীর বর্তমান ঠিকানার বাড়ীর মালিক সাত্তার মিয়ার স্ত্রী জানায়, মিঠু নামে কোন ভাড়াটিয়া তাদের বাসায় ভাড়া থাকে না। 

 

এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই কামাল হোসেন জানান, ঘটনা সত্য না, ভিত্তিহীন, ভাই আপনি অফিসে আসেন চা খেয়ে যান, আপনার সাথে কথা আছে। পরে এএসআই মোমেন আলম জানান, ভাই শোনেন শোনেন আপনার সাথে কথা আছে বলে ফোনটি কেটে দেন। 

 

এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি(সার্বিক) মো ঃ কামরুল ফারুকের সাথে মোবাইলে কথা হলে তিনি ঘটনার বিষয়টি এরিয়ে যান। 

 

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সাকের্ল (ক-অঞ্চল) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, এ ব্যাপারে আমার জানা নেই। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।
 

এই বিভাগের আরো খবর