রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ১৪ মে ২০১৮

বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে সারা বিশ্বের মানুষ৷ বিশেষত গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অ্যামেরিকা মহাদেশেও৷

বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রতিগ্রস্ত হয়েছে হন্ডুরাস, তারপরেই আছে মিয়ানমারের নাম৷ গেল ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কুফলে মারা যায় ৫ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (পিপিপি তে) ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ আর এর সরাসরি ফলাফল হিসাবে আবহাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজারটি৷

‘ইউএনইপি অ্যাডাপ্টেশন গ্যাপ’-এর ২০১৩ সালের রিপোর্টে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা ফলাফলের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খরচের পরিমাণ এখনকার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যাবে৷ আর বর্তমানে যা ধারণা করা হচ্ছে, তার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়বে ২০৫০ সাল নাগাদ৷ অন্যদিকে ঐ রিপোর্টটিতে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ার সীমা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে৷ এতে করে একদিকে যেমন মানুষের দুর্ভোগ কমবে অন্যদিকে নামতে থাকবে খরচের হারও৷

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল, এই ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যায়ক্রমে হন্ডুরাস, মিয়ানমার ও হাইতি৷ চতুর্থ অবস্থানে আছে নিকারাগুয়া, পঞ্চম ফিলিপাইন ও ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ৷ ভিন্ন কোনো বিপর্যয়, অথবা ক্রমাগত হুমকি? মিয়ানমারে ২০০৮ সালের ‘ঘূর্ণিঝড় নার্গিস’-এর কারণে যে পরিমাণ মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে, তা গত দুই দশকের অন্যান্য ঘটনার চেয়ে ৯৫ ভাগ বেশি৷ একইভাবে হন্ডুরাসে, ১৯৯৮ সালের ‘হ্যারিকেন মিচ’-এর কারণে ৮০ ভাগের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়৷ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ১০তম অবস্থানে থাকা থাইল্যাণ্ডে ২০১১ সালের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ ২০১২ সালের ‘হ্যারিকেন প্যাট্রিসিয়া’র ক্ষয়ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে৷ এই সময়ে সাইক্লোনের ঘটনা ঘটেছে ২৭টি৷

ফলে আবারও বলা দরকার যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ঝুঁকিতে আছে স্বল্পোন্নত ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো৷ জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার সংযোগ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ২০১৪ সালের মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো উঠে আসে৷ ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ ক্রমাগত বাড়ছে৷

একইভাবে, উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে৷ অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যার ওপর প্রভাব বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের মতো ধনী দেশগুলোর এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়তো তাদের খুব একটা গায়ে লাগবে না৷ কিন্তু দরিদ্র কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির কথা একবার ভেবে দেখুন! এই টাকা তাদের বার্ষিক জিডিপির একটি বড় অংশ৷ কাজেই তাদের অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে! আর ঘুরেফিরে সেই দেশের মানুষের ওপরই তো গিয়ে পড়ে সব ভোগান্তি৷ বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যেসব প্রভাব পড়ছে বলে আমরা উল্লেখ করেছি, এর সবগুলো ঘটতে শুরু করেছে বাংলাদেশেও৷

আশংকার কথা হলো, দিন দিন বাড়ছে এগুলো৷ বছরের প্রায় দশ মাস গরম থাকা, শুধু গরম বললে ভুল হবে৷ তীব্র গরম৷ বছরে কোনো রকমে দুই মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে এক মাসকে আমরা এখন শীতকাল বলে ধরে নিই৷ সেটি সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ এক মাস পর শীত আসবে, অথচ তখনও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে৷ বছরের মাঝখানে কারণে-অকারনে শুরু হয় অতিবৃষ্টি, যার ফলাফল হলো বন্যা৷ এ বছর যেমন শরৎকালেও ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ এসব ঘটনাকে গবেষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন৷ এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্য নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ৷ সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা৷

ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে যে, এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে৷ দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি আছে৷ এ কারণে ঘর হারাবে প্রায় দুই কোটি মানুষ৷ পার্বত্য এলাকায় অতিবৃষ্টি আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বিভাগে এরইমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ মাসের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজার, টেকনাফসহ এই বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দুইগুণ বেশি বৃষ্টি হয়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় পাহাড় এলাকার মাটির বুনন হালকা হয়ে যায়, আবার পরে অতি বৃষ্টির কারণে মাটি নরম হয়ে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা এসব এলাকায় বাড়ছে৷ অবশ্য অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটাও এমন ধসের অন্যতম কারণ৷

বজ্রপাত চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ১৭০ জন৷ আর গত সাত বছরে মারা গেছে ১ হাজার ৭৬০ জন৷ গবেষকরা বলছেন, কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়৷ সেখানে গত ৩০ বছরে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ১ ডিগ্রি৷ ফলে বেড়ে গেছে বজ্রপাতও৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলতি বছর পরপর তিনটি বন্যায় দেশের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়৷ বিশেষ করে উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে৷ ব্যাপক ক্ষতি হয় ফসলের, যার খেসারত দিতে হয় বা হবে সব মানুষকেই৷ এছাড়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি বেশি ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে৷ স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চার-পাঁচটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হয়৷ এছাড়া গত এক দশকে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু ও মোরা৷ এ ধরনের আঘাতের সংখ্যা যে বাড়বে তা বলা চলে নির্দধায়৷

এই বিভাগের আরো খবর