শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

দুইসৈন্য নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানীদের আনন্দ-ফুর্তিকরা বন্ধ হয়ে যায়

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহম্মেদ

প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহম্মেদের লেখা ফতুল্লার দত্তবাড়িতে এক অপারেশনে দুই পাকিস্তানী সৈন্য হত্যার  কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহম্মেদ : মুক্তিযুদ্ধের সময় ফতুল্লা রেলস্টেশনের কাছে একটি বাড়িতে, যে বাড়িটি সে এলাকায় দত্তবাড়ি নামে পরিচিত ছিল, সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করতো। তারা সে বাড়িকে একটি বিনোদন কেন্দ্রের রূপ দিয়েছিল। আমরা  ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে তখন আমাদের নিজ গ্রাম জালকুড়িতে অবস্থান করছিলাম। রহমতুল্লাহ নামে আমাদের পরিচিত এক ব্যক্তি পাকিস্তান বাহিনীর সে বিনোদন কেন্দ্রের খবর আমাদের জানায়। সেখানে অপারেশন করার জন্য রহমতুল্লাহ আমাদের অনুরোধ করে।সে বলে, পাক বাহিনীকে জব্দ করা দরকার। সে এলাকায় কোন নারী শান্তিতে থাকতে পারছিল না। এই কথা বলে সে সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।পরে আমরা সেখানে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেই।

 

ফতুল্লা রেল ষ্টেশন এলাকা আমাদের জালকুড়ি গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে। একদিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে জালকুড়ি থেকে পায়ে হেঁটে সেখানে যাই। প্রথমে আমরা পুরো দত্তবাড়িটি চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলি। এরপর অস্ত্র তাক করে আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বাড়িতে ঢুকেই গুলীবর্ষন করতে থাকি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেদিন সেই বাড়িতে মাত্র দুই-তিন জন পাকিস্তানি সেনা গিয়েছিল। আমাদের গুলীতে দুইজন পাকিস্তান সেনা সেখানেই নিহত হয়। আমরা পুরো বাড়ি তল্লাশি করতে বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় ফতুল্লা রেলষ্টেশনের কাছে ক্যাম্পে থাকা পাকিস্তানী সেনারা গুলীবর্ষন শুরু করে।

 

আমরা দত্তবাড়িতে পাকিস্তানীদের উপর হামলা করতে যে গুলিবর্ষন করি, সেই গুলীর আওয়াজ শুনে পাকিস্তানীরা হামলার বিষয়টি টের পেয়ে যায়। এরপরই রেলষ্টেশন থেকে পাকিস্তান বাহিনী গুলিবর্ষন করতে করতে দত্ত বাড়ির দিকে আসতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী সেখানে আসার আগেই আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে জালকুড়ির দিকে নিরাপদে চলে আসি। আমরা চলে আসার পর পাকিস্তান বাহিনী সেই এলাকায় বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং লোকজনের উপর খুব অত্যাচার করেছিল।

 

আমরা পরে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আরো বেশ কয়েকটি অপারেশন করেছি। প্রত্যেকটি অপারেশনই গুরুত্বপূর্ন ছিল কিন্তু ফতুল্লার দত্তবাড়িতে পাকিস্তান বাহিনীর বিনোদন কেন্দ্রে অপারেশন করাটা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সে অপারেশনের পর পাকিস্তান বাহিনী আর দত্তবাড়িতে গিয়ে আনন্দ-ফূর্তি করার সাহস পায়নি। সে অপারেশনের আগে সে এলাকায় মুক্তিবাহিনী আছে এটা পাকিস্তানীরা বুঝতে পারেনি। সে অপারেশন তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অনেক সাফল্যের কারণে এবং এমন ছোট ছোট আক্রমণেই পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল। সেটাই ছিল আমাদের সাফল্য। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সেইসব ছোট ছোট অপারেশনের কথা আমাদের মনে ঘুরপাক খায় এবং সেইসব অপারেশনের সাফল্য এখনো আমাদেরকে আনন্দ দেয়, আমরা গৌরববোধ করি।

 

৭১ সালে আমি ছিলাম জালকুড়ি জুনিয়ার হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। হাইস্কুলে পড়লেও আমরা তখন রাজনীতি সচেতন  ছিলাম। আমাদের এলাকায় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যারা আমাদের সব সময় রাজনীতি বোঝাতেন। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে যখন পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে তখন আমরাও আন্দোলনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু দিকে তাকিয়ে থাকতো। ৭মার্চে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।

 

এরপরই আমাদের  সামনে আসে ২৫ শে মার্চের কালো রাত। পাকিস্তানিরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। এরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শেষ পাকিস্তানি সেনাটিকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। সেই আহবান পুরো বাঙালি জাতির মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল এবং সবাই মুক্তিযুদ্ধে জাপিয়ে পড়েছিলেন।

 

এক পর্যায়ে আমরা জালকুড়ি থেকে দলবেঁধে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এক সকালে আমরা জালকুড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি আগরতলার উদ্দেশ্যে। আমার সাথে আরো ছিলেন নুরুল হক, মোহাম্মদ আলী, ফয়েজ আহমদ, ফজলুল হক প্রমুখ। আমরা শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে লক্ষণখোলা যাই। সেখানে গিয়ে  দেখি আমাদের এলাকার আমির আলী ডাক্তার, আজিজ দেওয়ান, আফতাব উদ্দিন দেওয়ান, মালেক, আনোয়ার আলী, শফি শিকদার, আব্দুর রহমান, রশিদ প্রমুখ সেই পথেই আগরতলা যাচ্ছেন। আমরা তাদের সঙ্গে মিলে আগরতলার দিকে রওয়ানা হই।

 

বিভিন্ন পথে কখনো লঞ্চে, কখনো হেটে, কখনো নৌকায় আমরা ত্রিপুরা সীমান্তে গিয়ে পৌছি। ত্রিপুরায় প্রবেশের সময় ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের ‘হল্ট’ বলে আমাদের হাত তুলে দাড়াতে বলে। কিন্তু তারা হিন্দিতে বলছিলেন বলে আমরা তাদের নির্দেশ ভাল করে বুঝতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে থাকা গোদনাইলের রওশন বললো, ভারতীয় সেনারা আমাদের থামতে বলেছেন। এরপর আমরা দুই হাত উপরে তুলে দাড়িয়ে থাকি। তারা কাছে এসে নিশ্চিত হন যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন নিতে এসেছি। এরপর আমাদের কিভাবে বাকী পথ যেতে হবে তা দেখিয়ে দেন। আমরা সে নির্দেশ অনুযায়ী কয়েক মাইল হেটে একটি শ্মরনার্থী ক্যাম্প পাই, সেখানে গিয়ে উঠি।

 

সেখান থেকে একদিন পর আমাদের পাঠানো হয় হাপানিয়া ক্যাম্পে। এরপর পাঠানো হয় মেলাঘর ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে আমরা জালকুড়ি-গোদনাইলের কেউ আছে কিনা খোজ করলে জালকুড়ির সাত্তার ভাই এগিয়ে আসে। তিনি আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে এলাকার আরো অনেককেই পেয়ে যাই। জালকুড়ির সিরাজ মামা, সিদ্দিরগঞ্জের গিয়াস ভাই ( এমপি), আবদুল রব প্রমুখে সঙ্গে দেখা হয়। তাদের পেয়ে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত হই যে, ঠিক জায়গায়ই এসেছি।

 

এরপর আমরা প্রশিক্ষণে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। আমাদের সঙ্গের আমির আলী ডাক্তারকে নারায়ণগঞ্জের এমপি জোহা সাহেব চিনতেন। পরদিন সকালে আমির আলী মামা আগরতলা শহরে গিয়ে জোহা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমাদের প্রশিক্ষনে যাওয়ার কথা বলেন। জোহা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে আমির আলীকে একটি চিঠি লিখে দিলেন। বললেন, এই চিঠি মেলাঘর ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের দেখালে তারা সবাইকে প্রশিক্ষনে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। সেই চিঠি দেখে ক্যাম্পের কর্মকর্তারা আমাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন যে, আমরা আসলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন নিতে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি। এরপরই আমাদের প্রশিক্ষন শুরু হয়ে যায়। প্রশিক্ষনে আমরা জুলহাস ভূইয়া, বারেক ভূইয়া, ফতুল্লার হাফেজ মোক্তার হোসেনকেও পাই। সবাই মিলেই আমার প্রশিক্ষন গ্রহন করতে থাকি।

 

মেলাঘরে আমাদের এক মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ সময় সব ধরনের হাল্কা অস্ত্র চালনা, গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরক ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মেলাঘরে প্রশিক্ষন শেষ হওয়ার পর আমাদের মধ্য থেকে আমির আলী ডাক্তার ও আরো একজনকে আরো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য পালাটানা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে মেলাঘরে অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দেয়ার পর প্রত্যক্ষ ফায়ারিং প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য আমাদের পাঠানো হয় মেলাঘরে কাছে বাঘমারা ক্যাম্পে। কিন্তু সেখানে আমাদের আগের এক গ্রুপের ফায়ারিং প্রশিক্ষণের সময় স্থানীয় এক রাখাল অসাবধানতাবশত গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সে কারনে সেখানে কিছুটা বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ফায়ারিং প্রশিক্ষন কয়েকদিন বন্ধ রাখা হয়। অবশ্য ২দিন পর আমরা সেখানে গিয়ে ফায়ারিং প্রশিক্ষন গ্রহন করি।

 

এ সময় একদিন মেলাঘর ক্যাম্পে এমপি জোহা সাহেব ও চুনকা সাহেবের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। তারা দু’জনই আমাদের বলেন, তোমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গেছে, তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো দেশে চলে যাও। দেশে গিয়ে যুদ্ধ করো। এরপরই আমরা দেশে চলে আসার প্রস্তুতি নেই। আসার আগে আমাদের বিপুল সংখ্যক অস্ত্র দেয়া হয়। সেই অস্ত্র নিয়ে আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া হয়। সীমান্তে আগেই গাইড (পথ প্রদর্শক) ছিল, তারা আমাদের বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কিভাবে বাকী পথ যেতে হবে তা বুঝিয়ে দেন। সেভাবেই আমরা দেশে ঢুকি। সেখান থেকে নৌকায় রামচন্দ্রপুর আসি। সেখানে একদিন থেকে পরদিন খুব সকালে আবার নৌকায় চড়ে লক্ষ্মনখোল পর্যন্ত চলে আসি।

 

লক্ষ্মণখোলা আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। আমাদের মনে হলো দিনের বেলা প্রকাশ্যে এত অস্ত্র নিয়ে জালকুড়ি গেলে বিপদ হতে পারে বা কেউ রাজাকারদের খবর দিয়ে দিতে পারে। এ আশংকায় লক্ষ্মণখোলায় আমাদের এক পরিচিত লোকের বাড়িতে পাটখড়ির (সোলা) পাড়ায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সকালে আমরা শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে জালকুড়িতে চলে আসি। জালকুড়িতে এসে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার লক্ষ্মণখোলা গিয়ে পাঠখড়ির (সোলা) আটির মধ্যে লুকিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জালকুড়িতে নিয়ে আসি। জালকুড়িতে এসে সেই অস্ত্র-গোলাবারুদ শফিদের বাড়িতে গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে দেই। কোন অপারেশনে গেলে গোপন জায়গা থেকে অস্ত্র বের করে নিয়ে যাই। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাকী সময়ে বিভিন্ন স্থানে অনেক অপারেশন করেছি।  

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর