রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন সেলিম ওসমান

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০২৩  

 

# দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অতিষ্ঠ মানুষ

 

 

একদিকে আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত আরেক দিকে একের পর এক দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে অতিষ্ঠ মানুষ। তার মাঝে শুক্রবার ফতুল্লা উইজডম এটায়ার্স লিমিটেডের মালিক ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ক্ষোভ ঝেড়েছেন। সেই সাথে মানুষযে জীবন যাত্রা নিয়ে অনেকটা কষ্টে আছে তাও প্রকাশ করেছেন তিনি।এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন এমনিতেই ওষ্ঠাগত। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আরেক দফা মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

 

বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম  বাড়ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলেও সেই অনুযায়ী আয় বাড়ে নাই। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলছে। ভোক্তারা নির্বিকার, বিশেষভাবে নিম্ন আয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না। তারা না পারে বলতে, না পারে সইতে।

 

এছাড়া সচেতন মহলের মতে, মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন অধিকাংশ প্রবীণ।

 

তারা না ঘরের মরা, না ঘাটের মরা। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কারণ চাকরিজীবনের তাদের সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেন নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা কিংবা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

 

জানা যায়, আসলে সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে একদম নির্বিকার। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। নামকাওয়াস্তে ভোক্তা অধিকার অভিযান পরিচালনা করলেও এতে তেমন কোন সুফল মিলছে না। অথচ ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছেন তা সর্বসাধারণের বিচার্য।

 

অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির অস্থিরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কেজিপ্রতি দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। বাজারে শুধু পেঁয়াজই ঝাঁজ ছড়াচ্ছে না। পেঁয়াজের পর তেল এবং তেলের পর গ্যাসের উত্তাপ। শাকসবজির বাজারেও আগুন। দ্রব্যমূল্যের আগুনে জ্বলছে ভোক্তা সাধারণ।

 

স্বাভাবিক ভাবে করোনা মহামারির পর এমনিতেই সব মানুষের আয়-রোজগার কম। অনেকে চাকরি ও কর্ম হারিয়ে দিশাহারা। অনেকে তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। কৃষকও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এরমধ্যে লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া ও সিন্ডিকেট চক্র। তাদের দৌরাত্ম্য এতটাই প্রবল, এদের হাতে জিম্মি খুচরা ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সাধারণ। সরকার যতই বলুক তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, আসলে মনে হয় সিন্ডিকেট চক্র সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আসলে দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কৃষকরা পেঁয়াজসহ অন্যান্য শস্য উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পায় না, ফলে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সরকার যদি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য ও প্রণোদনা দিত, তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঝাঁজ এত হতো না।

 

বর্তমানে চাল, তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা এক একটি অজুহাত দাঁড় করান এবং সরকারও তাদের সঙ্গে সমস্বরে সুর মিলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়। তা ছাড়া অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোনো পণ্য নেই, যা বাজারে পাওয়া যায় না অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত নামক সিন্ডিকেট চক্র। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ। নিত্যদিন তাদের পকেট কাটছে কিন্তু দেখার কেউ নেই, ভোক্তারা নির্বিকার ও চরম অসহায়।

 

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচ, পরিবহন ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সেহারে মানুষের আয় বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্য দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এক দিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

 

পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সংগত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অথচ এক বা দুই দশক আগেও এই অবস্থা ছিল না। মানুষ জীবন কাটাত সাধ্যের মধ্যে ভালো থেকে। শায়েস্তা খার আমলে এক টাকায় আট মণ চালের কথা যেন সময়ের রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামলেও দেশের দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল। সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। ইদানীং শোনা যায় বেঁচে থাকার তাগিদ থেকেও কেউ কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক চিত্র।

 

সমাজ বিদদের মতে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধভাবে দ্রব্য পাচার ও মজুদ রোধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি জমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে।

 

বাজারের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। মুনাফা খোরদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন ও উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে পণ্যের জোগান ঠিক রাখতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল, দেশের সব মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। যা মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে কৃষির প্রতি চাষাবাদে গুরত্ব দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি এক সভায় সকলের উদ্দেশ্যে বলেছেন, কোন জায়গা যেন ফাঁকা না থাকে। যার যতটুকু জায়গা আছে তাতে যেন সকল চাষাবাদ করেন। যা তিনি নিজে করেও দেখিয়েছেন।

 

মানুষ জন জানান, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষ। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুনাফাখোর সমাজের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা আশা করব, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

তাই সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইস্যুতে মুখ খুলে বলেন, এবারের ঈদ আমাদের সকলের জন্য চ্যালিঞ্জিং। কেননা এবারের ঈদে এমন কোন দ্রব্য মূল্য নেই যার দাম বাড়ে নাই। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি থেকে শুরু করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ইলেক্ট্রসিটির দাম বৃদ্ধির পেয়েছে। জীবন ধারনের জন্য আমাদের যে একটা বাজেট ছিল ওই বাজেট অনুযায়ী আমরা থাকতে পারতাছি না। আমরা যে খানে মাল বিক্রি বা রপ্তানি করি তাদের কাছে কোন অবস্থাতেই আমাদের আয় বাড়াতে পারছি না। তারা কোন অবস্থায়ই মালের মূল্য বারাচ্ছে না। এই সমস্যাটা সারা বিশ্বে। তার মাঝে ডলারের সংকটের সমস্যাতো আছেই। এই ঈদে আমরা গোশত কিনতে গেলে মাছ ক্রয় করতে পারবো না। এই বারের ঈদটা আমাদের জন্য চ্যালিঞ্জিং হবে। আর তা সকলকে মানিয়ে নিতে হবে।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর