শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৭ ১৪৩১

ধর্মীয় চেতনার প্রতীক কদম রসুল দরগাহ

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

 

# বিভিন্ন মোঘল শাসকগণ থেকে শুরু করে বর্তমান সকলের ভক্তিতে এই মাজার

 

ধর্ম মানুষকে শান্তির শিক্ষা দেয়। কোন ধর্মেই অন্যকে আঘাত করা কিংবা অন্যের উপর নির্যাতন করার নির্দেশ দেয় না। বরং যে কোন পাপের অনুশোচনায় প্রায়শ্চিত্ত করতে মানুষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নেয়। ধর্মের প্রধান শর্ত হলো বিশ্বাস। তাই হাজার হাজার বছর ধরে শান্তি প্রিয় মানুষরা একটু শান্তির খোঁজে এই ধর্মের ছায়াতলে এসে ঠাই নেয়।

 

এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে মসজিদ-মাজার, মন্দির, গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান। যেখানে চলে পূণ্যের আশায় সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে নিভৃত রাখার প্রয়াস। কদম রসুল দরগাহ এমনই এক ধর্মীয় চেতনার প্রতীক। লক্ষ লক্ষ ভক্তের প্রিয় এই দরগাহটি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার নাসিক (নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন) এর ২৩নং ওয়ার্ডের নবীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত অবস্থিত। যা এ দেশের দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলির মধ্যে নারায়ণগঞ্জকে গর্বিত করতে অবদান রেখেছে।

 

এ দরগাহ শরীফের নামানুসারে এখানে কদম রসুল এলাকা, কদম রসুল মৌজা, কদম রসুল পৌরসভা ও কদমরসুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এই মাজারে ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী-পুরুষ ছাড়াও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আগমন ঘটে। এখানকার জনগণের মতানুসারে মোঘল শাসনামলে ঈশা খাঁ, সম্রাট শাহজাহান, সুবেদার শাহ্ সুজা, সেনাপতি মাসুম খান কাবুলীসহ বিভিন্ন মোঘল শাসকগণ থেকে শুরু করে বর্তমান শাসনামল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি এই মাজার জেয়ারত করতে আসেন। মোঘল শাসনামলে অবসর সময়ে প্রায়ই সেনাপতি মাসুম খান কাবুলী তার সঙ্গীয় সৈন্যদের নিয়ে এই পবিত্র ধর্মীয় স্থানে এবাদত বন্দেগীতে রাত্রী কাটাতেন বলেও মনে করেন তারা।

 

কদম রসুল নামেই বুঝা যায়, রসুলের কদম (পা) কে বুঝানো হয়েছে। আর রাসুল (হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইছালাম) এর কদমের ছোঁয়া পড়েছে এমন একটি পাথর এখানে সংরক্ষিত আছে বলেই এই দরগাহের নামটির এমন নামকরণ করা হয়েছে বলে কথিত আছে যা এই এলাকার ধর্মভক্ত মানুষজন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। নবীজির পদচিহ্ন সম্বলিত সেই পাথরটিকে যেখানে রাখা হয়েছে তাকে বলা হয় পাইতি ঘর। এই পাইতি ঘরই দরগাহের মূল অংশ। আর এই পাথরটির ধারক হিসেবে হাজী নূর মোহাম্মদ শাহ (রা.) এর মাজারও গড়া হয়েছে তার ঠিক দক্ষিণ পাশে।

 

এই মাজারটিই এখানকার প্রধান মাজার। প্রধান মাজারের পাশে তার প্রিয় ১৩জন ভক্তের কবর স্থান পেয়েছে। পশ্চিম দিকে স্থান পেয়েছে আরও ৪টি মাজার। যেখানে নূর মোহাম্মদ শাহ’র একজন নাতির কবর আছে বলে জানা যায়। পাইতি ঘরের উত্তর পাশে আছে একটি দ্বিতল ভবনের মসজিদ। মাজারের পূর্ব অংশে আছে একটি মহিলাদের নামাজের ঘর, তার পাশে কামাল শাহ্ ও সৈয়দ বোরহান উদ্দিন শাহ এর মাজার। এর দক্ষিণ পাশে আছে একজন ভক্তের কবর।


 
এই দরগাহর ইতিহাস সম্পর্কে এলাকাবাসী মতে, মোঘল শাসনামলে মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আফগান সেনাপতি মাসুম খান কাবুলীর নেতৃত্বে সোনারগাঁ পরগনার শাসক ঈশা খাঁ একটি বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন এবং মোঘলদের কোন কর না দিয়ে সোনারগাঁয়ে স্বাধীনভাবে শাসন শুরু করেন। সম্রাট আকবর ঈশা খাঁ’র এ বিদ্রোহ দমনে তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মানসিংহকে এখানে প্রেরণ করেন।

 

মানসিংহের সাথে যুদ্ধের জন্য ঈশা খাঁ সোনারগাঁ থেকে তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে নদীপথে বর্তমান সোনাকান্দার কেল্লার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথিমধ্যে গভীর জঙ্গলের মধ্যে আলো দেখতে পেয়ে  তিনি সঙ্গীয় সৈন্যদের একাংশ নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখতে পান একজন সাধক (সৈয়দ হাজী নূর মােহাম্মদ (রাঃ)) ও তাঁর স্ত্রী মহামূল্যবান কষ্টিপাথরে খচিত একটি পায়ের ছাপ সম্বলিত পাথর মাথায় নিয়ে বসে আছেন।

 

ঈশা খাঁ এ বিষয়টি জানতে চাইলে সাধক জানা, পাথরটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র পদচিহ্ন। এ মহামূল্যবান পাথর খন্ডটির যেন অবমাননা না হয় তার জন্য আমি ও আমার স্ত্রী পালাক্রমে মাথায় রাখি। সাধকের কথায় ঈশা খাঁর মনে ভক্তি ও শ্রদ্ধা জাগে এবং সাধকের কাছে মানসিংহের সাথে যুদ্ধে জয়ের জন্য ঐ পবিত্র কদম মোবারকের চিহ্ন পাথরটির দোয়া প্রার্থনা করেন।

 

যদিও তিনি মানসিংহের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সাধক তাকে জানায় সে যদি ওয়াদা করে যে, যুদ্ধে জয়লাভ করলে এ পাথরটি কোন উচু এবং উপযুক্ত স্থানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে তাহলে অবশ্যই এর সে দোয়া পাবে এবং যুদ্ধে জয়লাভ করবে। ঈশা খাঁ প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অলৌকিকভাবে সে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এরপর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ঈশা খাঁর নির্দেশে তার সেনাপতি মাসুম খান কাবুলী এখানে এসে এর আশে পাশে কোন উচু জমি না পেয়ে এখানকার বিরাট এলাকা নিয়ে প্রায় ৬০ ফুট উচু মাটির টিলা তৈরী করে একটি সুন্দর গৃহে এ পবিত্র পদচিহ্ন সম্বলিত পাথরটি সংরক্ষণ করেন।

 

এরপর সম্রাট শাহজাহান যখন বাংলার তৎকালীন রাজধানী ঢাকা (জাহাঙ্গীর নগর) আসেন। তখন তিনি কদম রসুল দরগাহ পরিদর্শন করেন এবং ৬০ফুট উচু এই টিলায় খালি পায়ে উঠেন। সেদিন থেকেই সম্রাট শাহজাহানের সম্মানার্থে দরগাহ শরীফে খালি পায়ে উঠার রেওয়াজ শুরু হয়। পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিরোধ থাকায় শাহজাহান কদম রসুলে মানত করেন, তিনি কোনদিন দিল্লির সিংহাসনে বসতে পারলে এই পবিত্র দরগাহ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য খাদেম সৈয়দ হাজী নুর মোহাম্মদ (রা.) এর নামে ৮০ (আশি) বিঘা করমুক্ত জমি দান করবেন।

 

তাই পিতার মৃত্যুর পর তিনি নূরজাহান বেগমের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়ে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করার পর তার নির্দেশে তখনকার বাংলার সুবেদার শাহ্ সূজা দুই সনদে যথাক্রমে ৬০ ও ২০ মোট ৮০ বিঘা জমি সম্পূর্ণ করমুক্ত হিসেবে দান করেন। ফার্সি ভাষায় লিখিত সম্পত্তির দলিলটি শাহসূজার দস্তখত ও সীলমোহরসহ ঢাকা কালেকটরেটে মোহাফেজ খানায় সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।

 

১৯৩৮ সালে এ সম্পত্তি হাজী নূর মোহাম্মদ ওয়াকফ এস্টেট (আল-আওলাদ) নামে রেজিস্ট্রি করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশ ওয়াকফ অফিসেও সেই নাম ও নাম্বার বহাল আছে। যা সৈয়দ হাজী নূর মোহাম্মদ (রা.) এর বংশধর হিসেবে উক্ত ৮০ বিঘা সম্পত্তি বর্তমানে খাদেম পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন পর্চায় রেকর্ডভুক্ত হয়েছে বলেও জানা যায়।


 
তবে ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় মাসুম খান কাবুলী নামে একজন আফগান সেনাপ্রধান যিনি ইশা খাঁর বন্ধু ছিলেন তিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এই নিদর্শনটি (কদম মোবারকের চিহ্ন যুক্ত পাথরটি) একজন আরব সওদাগর-এর নিকট থেকে অর্থের বিনিময় ক্রয় করেন। তারও অনেক পরে সপ্তাদশ শতাব্দীর শেষদিকে গোলাম নবী নামে ঢাকার একজন জমিদার নবীগঞ্জের একটি উঁচু স্থানে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট দরগাহ নির্মাণ করে সেখানে পবিত্র পাথরটি স্থাপন করেন এবং গোলাম নবীর ছেলে গোলাম মুহাম্মদ কদম রসুল দরগাহের প্রধান ফটকটি নির্মাণ করেন।

 

পরে স্থানটি দর্শন করেন সুবাদার ইসলাম খান, মুঘল সম্রাট শাহজাহানসহ আরো অনেক আমির-ওমরা। সুলতান শুজা এই দরগার জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেন। পরে ঈসা খাঁর প্রপৌত্র দেওয়ান মনোয়ার খান এখানে একটি ইমারত তৈরি করেন। কিন্তু সেই ইমারতও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকাতে এই কদম রসুল দরগাহটি বিশাল জায়গা নিয়ে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মাটির টিলায় এটির অবস্থান। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) কদম মোবারক (পদচিহ্ন) সংবলিত এই কালো পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইতিহাস খ্যাত এ দরগাহ শরীফ কদম রসূল দরগাহ। যেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ এখানে আসে নবীজীকের সম্মান প্রদর্শন করার জন্য।


 
বৃহস্পতিবার সেখানে সরেজমিনে জমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খাদেমের দায়িত্বে আছেন খাদেম আল মামুন। তিনি জানান, মাজারটি বর্তমানে এখানকার ছয়টি খাদেম পরিবারে দায়িত্বে আছে। প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতি সপ্তাহে একজন করে পরবর্তী এক সপ্তাহের জন্য এর খাদেমের দায়িত্ব নেন। এখানে সোনারগা উপজেলার সম্ভুপুরা থেকে আসা এক দর্শণার্থী সম্ভুপুরা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেকলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জনি জানান, তিনি এখানে জেয়ারত করার জন্য এসেছেন। এখানে এসে তার মনে এক ধরণের প্রশান্তি চলে এসেছে।