শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৭ ১৪৩১

ধুঁকছে বন্দর উপজেলা আ.লীগ

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৪  

 

 

দেশজুড়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এখন সোনালী সময় পার করছে বলে মনে করা হয়। অথচ এই সুসময়েও ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে বন্দর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব। এখানকার আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব সংকট নিয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েক বছর যাবতই আলোচনা সমালোচনা চলছে বন্দর তথা জেলা জুড়ে। দলের কিছু স্বার্থান্বেষী নেতা তাদের নিজেদের স্বার্থে দলকে সুসংগঠিত করতে দিচ্ছেন না বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কর্মীর অভিযোগ। 

 

এবার আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনেও বন্দর আওয়ামী লীগের নাজুক অবস্থা ফুটে উঠেছে। বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বর্তমানে রয়েছেন দেশের বাইরে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজিমউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরও বেহাল অবস্থা আওয়ামী লীগে। গতকাল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উপজেলা আওয়ামীলীগের ৫নং সহ-সভাপতি মাসুম আহম্মেদের নেতৃত্বে উপজেলা এককোনায় দায়সারা প্রোগ্রাম করেছে। 

 

অধিকাংশ নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতে সাদামাঠা ভাবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কেক কেটে উদযাপন করেছে  বন্দর উপজেলা আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।  এ উপলক্ষে রোববার  (২৩জুন) বাদ আছর বন্দর উপজেলার  ফরাজিকান্দাস্থ  উপজেলা আ’লীগের কার্যালয়ে এ আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ একাধিক  নেতা গনমাধ্যমকে জানিয়েছে,   সদ্য উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ও উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রয়াত সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব কাজিম উদ্দিন প্রধানের মৃত্যুতে বন্দর উপজেলার আওয়ামীলীগের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পরেছে। বন্দরে নেতা নেতায় বিরোধ থাকার কারনে এখন দলীয় কোন কর্মমূচিতে  অংশগ্রহন করতে দেখা যায় না নেতাকর্মীদের। আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে  আলোচনা সভার সভাপতিত্বে  বন্দর উপজেলা আ’লীগের সহ সভাপতি ও মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী এমএ সালাম।

 

সভাপতির বক্তব্যে এমএ সালাম বলেন, ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই সুত্রে ৭৫ বছরে ১৯৭১ সনে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার এবং পরে শিক্ষা,সংস্কৃতি,যোগাযোগ, আবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া ও ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের অবদান সবই আ’লীগের ফসল। অতএব আজকের এই দিনটি আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আ’লীগ একটি সুসংগঠিত সুশৃঙ্খল দল।

 

 আ’লীগ প্রকৃত পক্ষে যারা করেন তারা কখনো দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যান না এটা আমি মনে করি। যারা বিগত দিনে আ’লীগে থেকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বেইমানি করেছেন তারা কখনো প্রকৃত আ’লীগ করেন নি। তাই আজকের এই উৎসবের দিনে আমরা শপথ করি যাতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় দলের সিদ্ধান্ত মেনে প্রকৃত আ’লীগের অনুশাষন মেনে কাজ করি।

 

কলাগাছিয়া ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারন সম্পাদক ইব্রাহিম কাশেমের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নবাগত উপজেলা পরিষদ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান সালিমা হোসেন শান্তা, বন্দর উপজেলা আ’লীগের সহ সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক মিয়া,যুগ্ম সম্পাদক ভোলানাথ দাস, 

 

সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রউফ, কৃষি সম্পাদক হাজী নাছির,সাংস্কৃতিক সম্পাদক এসআই জুয়েল,বন্দর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ফয়সাল কবির,ধামগড় ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল আলী, মুছাপুর ইউনিয়নের আ’লীগের সভাপতি মুজিবর,বন্দর ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাড.তাজুল ইসলাম,রুহুল আমিন,শাহিন তাহেরী সিনহা,সোয়েব মোহাম্মদ লিটন, হাবিবুর রহমান প্রমূখ।

 

এদিকে সম্প্রত অনেকে বলছেন, বন্দরে আওয়ামী লীগ যদি শক্তিশালী হয় তাহলে কি একজন নেতা টানা ২০ বছর দলের নেতৃত্বে দিতে পারে! বন্দরে আওয়ামী লীগ যদি শক্তিশালী হয় তাহলে কি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরেও এই আসনে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের লাঙ্গলের প্রার্থী টানা ৪ বার এমপি নির্বাচিত হতে পারে! তাই নিজেদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না রাখার জন্যই এখানকার আওয়ামী লীগের প্রধান সেই সাংসদের পরিবারের সাথে আঁতাত করে বন্দর আওয়ামী লীগকে দুর্বল করে রাখার গভীর চক্রান্তের ছক কষে বেড়ান বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন।

 

 গতকাল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনেও জেলার বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের কমিটির দুর্বলতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল ওরফে ভিপি বাদল। বিষয়টি নিয়ে বন্দর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই বলতে শোনা যায় ভিপি বাদল আমাদের বন্দর আওয়ামী লীগের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। গতকাল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও বন্দর আওয়ামী লীগের প্রথম সারির বড় কোন নেতাকে যায়নি অভিযোগ বন্দর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।

 

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী একটা সময় বন্দর আওয়ামী লীগের বোবা কান্না নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশ করা হতো। অনেক নির্যাতন সহ্য করেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীরই তা প্রকাশ করার সাহস ছিল না। কারণ এই নির্যাতনের প্রতিকার কিংবা অন্যায়ের বিচার চাওয়া মানেই তার উপর নতুন করে বাড়তি নির্যাতনের গড়গ পড়া। এর মধ্য থেকেই বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে কিছুটা হলেও উঠে আসে প্রকাশ্যে।

 

তারপরও সেসব নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের কোন প্রকার সান্তনা না দিয়ে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে একই দলের কিছু স্বার্থবাদী নেতা কর্মীকে। তবে মিডিয়ার বদৌলতে এখন আর বোবা কান্না নয়, বন্দর আওয়ামী লীগের অনেক দুর্ভোগের কথাই প্রকাশ্যে আসে। মিডিয়ার সাহসী ভূমিকার কারণেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া একটি দল ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সেই দলেরই নেতা ও দলপ্রেমিকদের প্রকাশ্যে দেখা গেছে রাজাকার পরিবারের সন্তানদের নিয়ে একই মঞ্চে বসে থাকার দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

 

 সেসব সুবিধাবাদী নেতারাই আবার নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে মাইক্রোফোনের সামনে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। নারায়ণগঞ্জের একটি প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা নিজেদের আওয়ামী লীগের কঠিন প্রেমিক হিসেবে উল্লেখ করে বন্দরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা নিজেরাও চান না এখানকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাদের সেই ভক্ত ছাড়া অন্য কেউ হোক।

 

স্থানীয়দের মতে বন্দর আওয়ামী লীগের দুর্দশা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কিছুই নেই। বিগত ইউপি নির্বাচন গুলোর ফলাফল দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষ করে কলাগাছিয়া ইউনিয়ন, বন্দর ইউনিয়ন ও মুসাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী জয়ী হতে পারছে না। তাদের মতে এখানকার আওয়ামী লীগ প্রধান বন্দর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখানকার আওয়ামী লীগের দুর্দশা শুরু হয় গুরুতরভাবে। 

 

এর আগে দায়িত্বে থাকা সফিউদ্দিন আহমেদ (প্রয়াত) দায়িত্ব ছাড়ার পর (অনেকের মতে তার কাছ থেকে দায়িত্ব ছিনিয়ে নেয়ার পর) এই দুর্দশার শুরু। সফিউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব ছাড়ার পর তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতী ঘটেনি। কিন্তু এই কয়েক বছরে বন্দর আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রধানের আর্থিক অবস্থা যে কতটা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তা একটু তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে বলে তাদের অভিমত। 

 

সূত্র আরও জানায় শুধু প্রধানেরই না তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের এমনকি যারা তার পিছনে লেজুরের মতো ঘুরে বেড়ায় তাদেরও আর্থিক অবস্থা খুবই দ্রুত উন্নতি হয়েছে। অনেকটা আলাউদ্দিনের চেরাগ পাওয়ার অবস্থা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একধিক সূত্র জানিয়েছেন এখানকার কোন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন শক্তিশালী নেতা যাতে প্রার্থী হওয়ারই সুযোগ না পান সে জন্য আগে থেকেই গেম সাজানো হয়। তাই গত ইউপি নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগের একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কাজিম উদ্দিন প্রধান (প্রয়াত)। তখন তার বিরুদ্ধেও কঠিন চক্রান্ত করা হয় বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ আসে।

 

স্থানীয়দের দাবি বন্দর আওয়ামী লীগের এই অসহায় অবস্থা থেকেই গত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব থেকে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। আর গত জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সেই দাবির প্রতি জোরালোভাবে সমর্থন করে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ। সে সময় এসব নেতারা বন্দর আওয়ামী লীগের দুর্দশার দৃশ্য ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে। 

 

গত ইউপি নির্বাচনে বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কাজিম উদ্দিন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে এখানকার আওয়ামী লীগের শোচনীয় অবস্থা দলের নেতা কর্মীদের খুব কাছাকাছি থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ পান। তার পর থেকেই তিনি বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগকে পুনরুদ্ধার করার জন্য কাজ শুরু করেন। তার উদ্যোগেই বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা একটি প্রাণবন্ত কার্যালয় পান বলে অনেককেই বলতে শোনা যায়। 

 

তবে কয়েক মাস আগে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাজিম উদ্দিন প্রধানের মৃত্যুর পর তার সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। আবার থমকে দাঁড়ায় বন্দর আওয়ামী লীগের পুনরুদ্ধার অভিযান। যার ফলাফল পাওয়া যায় গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের উপর। যেখানে একজন কুখ্যাত রাজাকার পরিবারের সন্তান, যে এই সাংসদ ও আওয়ামী লীগের এই সুবিধাবাদী নেতাদের হাত ধরে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেন।

 

 সেই রাজাকারের সন্তানের কাছেই ধরাশায়ী হন সেই আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা নেতা। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের দুর্দশার কারণে এবং দলে হাইব্রিড ও কাউয়া মার্কা নেতারা প্রবেশ করায় একই সাথে দলের ত্যাগী ও তৃণমূলরা মূল্যহীন হয়ে পড়ায় এই রাজাকার পরিবার এখন পাওয়ার থেকে সুপার পাওয়ারে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে বেড়াচ্ছে বলে চাউর হয়েছে।

 

এই বিভাগের আরো খবর