না.গঞ্জে আ.লীগের দৈন্যদশা প্রকাশ পেয়েছে
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ০৪:১৫ পিএম
কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিসংতায় রূপ নিলে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলির এলাকাগুলোতে একেরপর এক তাণ্ডব চালানো হয়। শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে গিয়ে নাশতকাকারীরা সরকারি-বেসরকারি নানা অফিস, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন, লুটপাট, ভাঙচুর চালায়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নারায়ণগঞ্জ এক প্রকার গোটা দেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় রেহাই পায়নি শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় অবস্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয়। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এসময় তারা প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের নিচতলায় রীতিমত তাণ্ডব, ভাঙচুর, লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এসি, ফ্যান, চেয়ার কিছুই বাদ রাখেনি দুর্বৃত্তরা। কার্যালয়ভবনের দোতলায় প্রতিটি কক্ষে চালানো হয় তাণ্ডব, ভাঙচুর, সোজা কথায় গোটা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পুরোটাতেই তছনছ করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। সূত্র জানিয়েছে, দুর্বৃত্তরা ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আশেপাশের মার্কেটগুলোর ব্যক্তিরা অনুনয় বিনয় করায় কোনরকমে আগুন থেকে নিষ্কৃতি পায় ভবনটি। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশেই সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মিনি পার্কে স্থাপিত বঙ্গন্ধুর ম্যুরালটিও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এসময় ম্যুরালটি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলে ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বত্তরা। ভাঙচুর চালানো হয়েছে ১৬নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও। ভাঙচুর, তছনছ করে লুটপাট চালানো হয়েছে। আলী আহম্মদ চুনকা মিলনায়তনেও ভাঙচুর, হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। তবে শহরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উপর যখন এসব তাণ্ডব চলছে স্থানীয় কোন আওয়ামী লীগ নেতাই দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। ঘটনার বেশঅনেক্ষণ পর ২নংগেট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে পরিদর্শনে যান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল হাই, সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান বাচ্চু, সাবেক সহ-সভাপতি আরজু রহমান ভূইয়া, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, পরিদর্শন করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান। এক ফাঁকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এড. খোকনসাহাসহ আরো কয়েক নেতা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন।
এদিকে গতকয়েকদিনে তাণ্ডব চলাকালীন এসব প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে। মাঠ পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান, তার পুত্র অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরীওসমান, আওয়ামী লীগ নেতা শাহনিজাম, সাজনুসহ ছাত্রলীগের কিছু কর্মীদের মাঠে দেখা গেছে। ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তারা মাঠে সরব ছিলেন। তবে যুবলীগ, মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক কমিটির বেশিরভাগ নেতাকেই গোটা সময়জুড়ে দেখা যায়নি।
২নং রেলগেটে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে পরিদর্শনের সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাইয়ের সামনে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই আমাদের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা হয়! ভাঙচুর হয়! আজ কোথায় সেইসব সুবিধাভোগীরা যারা নিজেদের এতোদিন আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে জাহির করেছেন। তারাই আবার আগামীকাল সকালে বলবে তারা বড় আওয়ামী লীগ। দল ক্ষমতায়থাকা অবস্থায় এমন অবস্থা দেখতে হবে তা কল্পনাও করা যায়না।’
এদিকে এসব তাণ্ডবে আওয়ামী লীগ নেতারা কেন মাঠে নামেননি তা নিয়ে চলছে জোর বিশ্লেষণ। প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় গড়িয়ে গেলেও এখনো জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই আর সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ মো. বাদল (ভিপি বাদল) কে দিয়ে চলছে খুঁড়িয়ে জেলা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতি, মুখ চেনা আর সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের নাম দিয়ে কেন্দ্রে আলাদা কমিটি পাঠায় এই দুই নেতা। কেন্দ্র সেটি টের পেয়ে এখন অবধি কমিটি দেয়নি। অপরদিকে ২০১৩ সালে দেয়া মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আর সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহায় অসন্তুষ্ট গোটা মহানগর আওয়ামী লীগ। এক যুগের বেশিসময় ধরে ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে না পারলেও শেষে যেসকল ওয়ার্ড কমিটি গঠন করেছে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাতসহ এক ঝাঁক নেতা এইসব কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেছেন। পাল্টাপাল্টি একে অপরকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগেরও দৈন্যদশা। সভাপতি এমএ রশিদকে অপছন্দ ও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করায় সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হলে ভরাডুবি ঘটে। সাধারণ সম্পাদক কাজিমউদ্দিন প্রয়াত হওয়ার পর তার পদ দখল নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। অচলাবস্থার মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে। ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের অবস্থা কেতাবে আছে গোয়ালে নেই এমন। ভুড়ি ভুড়ি আওয়ামী লীগ নেতার নাম নানাসময়ে বের হলেও চলমান সমস্যায় তাদের ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম সাইফুল্লাহ বাদল আর সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলীর সাংগঠনিক দূর্বলতাও এখানে প্রকাশ পেয়েছে। লিংকরোড ও সাইনবোর্ডে চলমান নাশকতায় ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ নেতারা একেবারেই নাজুক অবস্থায় ছিলেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিুবুর রহমানের বাড়িতে তো হামলাই হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়াও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের ওয়ার্ড ঘেষা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হলেও তা প্রতিরোধে গোটা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগসহ সব সংগঠন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আগামীতে গোটা নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের এসব কমিটি ভেঙে নতুনভাবে শক্তিশালী না করা হলে অচিরেই সুবিধার রাজনীতির কড়ালগ্রাসে নিমজ্জিত হবে আওয়ামী লীগ।
এসব ঘটনার মধ্যে অন্যমত আলোচিত বিষয় নারায়ণঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ভবনে দেয়া আগুন, ভাঙচুরের ঘটনা। এই ঘটনার জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বন্দরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সন্ত্রাসী খান মাসুদকে দায়ী করেছেন। শনিবার সকাল ১১টায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে নগরভবনে পরিদর্শনে এসে মেয়র আইভী এই কথা বলেন। মেয়র বলেন, খান মাসুদের দুইজন লোক সিটি কর্পোরশেন ভবনে আগুন, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার সাথে জড়িত আছে। তা না হলে এতো কিছু রেখে তারা কেন, আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগার ও সিটি কর্পোরেশনে হামলা চালাবে। এটি একটি ষড়যন্ত্র। এসময় উপস্থিত ছিলেন, ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ^াস, ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান ও ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না।
এদিকে আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শন শেষে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, নারায়ণগঞ্জের আওয়ামীলীগ কার্যালয়, সিটি কর্পোরেশন ভবন, নম পার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা হামলা চালিয়েছে বিএনপি-জামাত। এসব হামলায় বিএনপি-জামাত ও ভাড়া করা লোক ছিল। আগেও নানা বিশৃঙ্খলা ঘটলেও কেউ আমাদের কার্যালয়ে হামলা চালানোর দুঃসাহস দেখায়নি। আমাদের পার্টি অফিসে একটি স্টিলের আলমারী ছিল তারা সেটিও নিয়ে গেছে। এমনকি হ্যান্ড মাইকও নিয়ে গেছে। ওইদিন রাতে নারায়ণগঞ্জক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। তারা এসব জায়গায় হামলা করবে আমরা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। এসব হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। যাা এসব হামলায় জড়িত তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। আমরাও দলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেবো। মামলা হলে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
এদিকে বুধবার দুপুরে ২নং গেট আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক। তিনি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে অন্যান্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এরপর আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শনে আসেন সংসদীয় হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। তিনি বলেন, রাজনীতির নামে বাংলাদেশে যে অত্যাচার সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ^ ইতিমধ্যেই দেখেছেন। আমরা খুনী তারেকের বিচারসহ ওই প্রতারক চক্রের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছি। আমরা তাদের বিচার চাই, গ্রেপ্তার চাই। হামলাকারীদের আমরা ছাড় দিতে পারিনা। রক্তের বিনিময়ে হলেও আমরা যোগ্য জবাব দেব। তারা বাথরুমের কমোড, পার্টি অফিসের কম্পিউটারও চুরি করে নিয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা এসবের জবাব দেব। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য এড. আনিসুর রহমান দিপু, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আহসান হাবীব, সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।