বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

নানা সংকটে শিক্ষাব্যবস্থা

আবু সুফিয়ান

প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২  

 

বিভিন্ন ভাবে বর্তমান মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মেধা ছিনতাই করা হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম নোট, গাইড বই ও কোচিং। এই মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মেধা এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ সমূলে বিনষ্ট করে দিচ্ছে নোট, গাইড বই ও কোচিং ব্যবসার মাধ্যমে। শিক্ষিত মানুষদের একটি অংশ মেধা সম্পন্ন প্রজম্ম তৈরি হোক সেটা চান না। যদি চাইতো তাহলে নোট, গাইডবই প্রকাশ করত না এবং কোচিং সেন্টার গড়ে উঠতো না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতো না। প্রশ্ন ফাঁসের কারনে মেধাবি শিক্ষার্থীরা ধ্বংস হচ্ছে। নোট বই, গাইড বই ও কোচিং শিক্ষার ফলে সহজে পরীক্ষায় পাস করা যায় কিন্তু প্রকৃত বিদ্যা অর্জন করা যায় না।

 

নোট, গাইড বই, কোচিং বিহীন লেখাপড়া করলে মেধার বিকাশ ঘটবে, নচেৎ সম্ভব নয়। শিক্ষাকে বর্তমানে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। নোট বই, গাইড বই ও কোচিং ব্যবসার মাধ্যমে শিক্ষাকে অর্থ দিয়ে কিনে নিতে হচ্ছে। যাদের অর্থ আছে তারা অর্থ দিয়ে নোট, গাইডবই ও কোচিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা কিনে নিচ্ছেন। আর যাদের অর্থ নেই তারা এই শিক্ষা কিনতে পারছেন না। এই শিক্ষা আসলে প্রকৃত শিক্ষা নয়, কেননা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পাস করার জন্য লেখাপড়া করছে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়।

 

শিক্ষা আইনে শিক্ষার্থীদের জন্য সব ধরনের নোট, গাইড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সরকারের অনুমতি নিয়ে সহায়ক বই প্রকাশ করা যাবে। শিক্ষকরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট, কোচিং করাতে পারবেন না। তবে ফ্রিল্যান্সিং কোচিং চালাতে বাধা থাকবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালে কোচিং-এ যেতে পারবেন না। শিক্ষা আইনের ১৬ ধারার ১ ও ২ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

 

উপধারা ৩-এ বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নোট বই বা গাইড বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক এখতিয়ারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। উপধারা ৪-এ বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারার ১ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে অভিভাবকদের লিখিত সম্মতিতে স্কুল সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যাবে।

 

অর্থনৈতিক সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে। রিজার্ভের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বাড়ছে। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে এবং সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শিক্ষা উপকরণ সহ সকল জিনিসপত্রের দাম অকারণেই আকাশচুম্বী। অভিভাবকর বলছেন, সরকারকে এখনই শিক্ষা উপকরণের দাম কমানো সহ শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণমূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। বৃদ্ধি পেয়েছে নিউজ প্রিন্টসহ সাদা কাগজের দাম। খাতা-কলম, রাবার, পেনসিল, জ্যামিতি বক্স, সাধারণ ক্যালকুলেটর, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর, জিপার ফাইল, স্কুল ব্যাগসহ প্রতিটি শিক্ষা সামগ্রীর দাম বাড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

 

এদিকে নতুন বছরে নতুন বই পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। এ সংশয়- এর অবশ্য যথেষ্ঠ কারনও রয়েছে। মাধ্যমিকে নারায়ণগঞ্জে বইয়ের চাহিদা ৪১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৭২৫ টি। অন্যদিকে প্রাথমিকে সর্বমোট বইয়ের চাহিদা ১৫ লক্ষ ২১ হাজার ২৯৪ টি। সম্পূর্ন বই হাতে পাওয়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার সত্রে জানা যায়, সম্পূর্ন বই হাতে পাওয়া সহ ৫ তারিখে ক্লাস চালু করতে কোন রকম অসুবিধা হবে না। সম্পূর্ন বই হাতে পাওয়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জের অভিভাবকরা বলেন, সবকিছু পহেলা জানুয়ারি জানা যাবে, কিন্তু সব বই হাতে পেলে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ হবে বলে তারা জানান।

 

একটি জাতি বা দেশকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে হলে আগে প্রয়োজন শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা। পৃথিবীতে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রায় শতভাগ লোকই শিক্ষার আলোয় আলোকিত। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত রাষ্ট্রের পক্ষ হতে সব নাগরিকের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। জাতীয় শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায় বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম প্রথমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করা হয়। তবে এ কর্মসূচি বর্তমানে শহর ও গ্রামাঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয় নির্বিভেদে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিস্তৃত।

 

দেখা যায়, প্রথম থেকে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী সরকারের কাছে থেকে অনুদান হিসেবে যেসব পাঠ্যপুস্তক পায়, এর মূল্যমান ৩ শত থেকে ৩ হাজার টাকা। এখন মাধ্যমিক পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি স্কুলের শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে যে বই দেয়া হচ্ছে; দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় তা শতভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ সমর্থনযোগ্য কি না বিবেচনার দাবি রাখে। অনেক অভিভাবকের প্রশ্ন বিনামূল্যে বই বিতরণ কি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সন্তোষজনক শিক্ষাদান নিশ্চিত করে কোচিং-বিমুখতা রোধ করতে পেরেছে? রোধ করতে না পারলে যেসব অভিভাবক কোচিংয়ের পেছনে মাসিক আয়ভেদে ৫ শত থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছেন তাদের সন্তানকে বার্ষিক ৩ শত বা ৩ হাজার টাকার পুস্তক বিনামূল্যে দিয়ে আর্থিক সমর্থন দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

 

বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণে যে অর্থ ব্যয় হয় এ অর্থ শিক্ষক ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করা হলে দেশ ও জাতি অধিক হারে লাভবান হবে। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনী কার্যক্রম চালু-পরবর্তী দেখা গেছে, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির আওতায় কোচিংকে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারে উল্টো। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষা দু’টি প্রতিযোগিতমূলক হওয়ায় অভিভাবকরা সন্তানদের সব বিষয়ে ‘এ প্লাস’ নিশ্চিতকরণে আগে কোচিংয়ের দ্বারস্থ না হলেও এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই হচ্ছেন। এতে করে শিক্ষা গ্রহণের ব্যয়ভার বেড়ে যাচ্ছে; যা অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের মিটানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

 

সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু-পূর্ববর্তী স্কুলশিক্ষকদের প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব স্তরে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেয়া আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু অল্প কিছু শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে কার্যক্রমটি চালু করায় এর সফলতা মেধা বিকাশে যে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না, তা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা ইতোমধ্যে অনুধাবন করতে পেরেছেন। প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষায় শতকরা পাসের হার শতভাগের কাছাকাছি দেখিয়ে যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতির সুফল এ সফলতার ভাগীদার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

 

প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে দেখা যাবে, পাসের হারের এবং ‘এ প্লাস’ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যে কৃতিত্বের দাবি করা হচ্ছে তা আদৌ ঠিক নয়। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু-পরবর্তী নোট, গাইড বই এ পদ্ধতির বিকাশে অন্তরায় একথা বলে এগুলোর প্রকাশনা ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তব অবস্থা হচ্ছে নোট, গাইড বইয়ের অনুপস্থিতিতে শতভাগ শিক্ষার্থী কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে করে শিক্ষার ব্যয়ভার অনেক বেড়েছে। তাছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা হতে ভিন্নধর্মী হওয়ায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোচিং ফির অতিরিক্ত মডেল টেস্টে অংশ নিয়ে নিজের সক্ষমতা যাচাই করে দেখতে হচ্ছে। এতে শিক্ষার ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ছে সহজে অনুমেয়।

 

দেশে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুলগুলোতে প্রতিটি শ্রেণীর প্রতি শাখায় শিক্ষর্থীদের সংখ্যা ন্যূনতম ৮০ জন। একজন শিক্ষকের পক্ষে ৩৫-৪০ মিনিট ব্যাপ্তির শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় এত বিপুল শিক্ষার্থীর প্রতি মনোনিবেশ করা কতটুকু সম্ভব তা ভেবে দেখার দাবি রাখে। স্কুলশিক্ষকরা বেতন-ভাতা হিসেবে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে যে অর্থ পান, তা চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় নির্বাহে যথেষ্ট কি? যথেষ্ট না হয়ে থাকলে জীবনধারণের তাগিদে স্বভাবতই শিক্ষকরা বিকল্প আয়ের পথ খুঁজবেন। শিক্ষকদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে কোচিং সেন্টারে শিক্ষাদান অথবা নিজগৃহ অথবা শিক্ষার্থীদের বাসায় পড়ানো হতে পারে নীতি-নৈতিকতা সমুন্নত রেখে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে জীবনযাপন ব্যয় নির্বাহের ঘাটতি অর্থের জোগানের ব্যবস্থা।

 

শেষোক্ত দুটি পথে অর্থ উপার্জন শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয়বহুল। একই সাথে শিক্ষকদের জন্য তুলনামূলক বিচারে অসুবিধাজনক। ফলে কোচিং সেন্টারকেই শিক্ষকরা বিকল্প পথে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু সরকার সম্প্রতি যে কোচিং নীতিমালা ঘোষণা করেছে; তাতে ভালো স্কুলের শিক্ষকদের কোচিংয়ের মাধ্যমে জীবনযাপনে অবশিষ্ট আয়ের পথ হয়েছে রুদ্ধ। অন্যদিকে নিম্নমানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরিচালিত নামসর্বস্ব কোচিং সেন্টারের অর্থ উপার্জনের পথ হয়েছে প্রশস্ত। এসব নামসর্বস্ব কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে।

 

ভালো স্কুলের শিক্ষকদের দিয়ে পরিচালিত কোচিং সেন্টারে যে মানের শিক্ষা দেয়া হয়; বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সদ্য পাঠ শেষ করেছেন এমন কোচিং সেন্টারে শিক্ষার মান অনেক নিচে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক যাদের তুলনামূলক মান যাচাইয়ের সুযোগ হয় না; তাদের সন্তানরা আশানুরূপ ফল না করায় তারা ব্যথিত হচ্ছেন। ভালো স্কুলের শিক্ষকদের কোচিং মান নিয়ে সন্তুষ্ট এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেক অভিভাবকের প্রশ্ন শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ করা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষকতা পেশার সাথে সম্পৃক্ত নন এমন অনেকে যারা কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন তারা কি বাদ দিয়েছেন? কোচিং নীতিমালা অনুযায়ী, ভালো স্কুলের শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে পাঠদান শেষে নিজ স্কুলে কোচিং করালে শিক্ষার্থীপ্রতি ৩০০ টাকা করে নিতে পারবেন।

 

তাছাড়া এ নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, ভালো স্কুলের একজন শিক্ষক নিজ স্কুলবহির্ভূত সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন। উভয় ব্যবস্থা শিক্ষকদের শ্রম, কোচিং সংশ্লিষ্ট ব্যয় ও আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় ভালো স্কুলের শিক্ষকদের এ ব্যবস্থা আকৃষ্ট করতে পারেনি। এর সুযোগ নিচ্ছে অখ্যাত স্কুলের শিক্ষক ও বিজ্ঞাপননির্ভর নামসর্বস্ব কোচিং সেন্টারগুলো। এর মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা না পাওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ই ক্ষতির সম্মুখীন। কথাটি অনস্বীকার্য যে, আধুনিক পদ্ধতিতে সমন্বিতভাবে পাঠদান করা হলে কোচিংয়ের আবশ্যকতা থাকবে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ সুবিধা এমন হতে হবে; যাতে ভদ্রোচিত জীবনযাপনে কোনো অসুবিধা না হয়।

 

এটিও ঠিক যে, এমন কিছু শিক্ষক আছেন; যাদের কোচিং ব্যবসা এমনভাবে পেয়ে বসেছে, নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তারা প্রতিদিন একাধিক ব্যাচে কোচিং করিয়ে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। অনেক স্কুলের ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল উন্নয়নের নামে যে ফি নেয়া হয়, ওই টাকার সঠিক হিসাব স্কুল পরিচালনা পর্ষদ দিতে পারবে না। বিভিন্ন ভালো মানের স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে কৃতকার্য হওয়া তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ায় এবং আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় অধিকাংশ ভর্তিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক বিফল হয়ে বাঁকা পথে ভর্তির সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এতে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সাথে সম্পৃক্তরা বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।

 

আকর্ষণীয় ও লোভনীয় অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকায় ভালো স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে থাকে। এই নির্বাচনে এমন অনেকে রয়েছেন যাদের ব্যয় কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। এতো বেশি ব্যয়ে নির্বাচিত হওয়ার একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে অবৈধ প্রাপ্তি। ছাত্রছাত্রী ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগে কয়েক লাখ টাকা নেয়া হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। ভর্তিবাণিজ্য বন্ধে যদিও কিছু স্কুলের ক্ষেত্রে লটারি প্রথা প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত মেধাবীদের প্রতি এক দিকে নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে এমন সব নিম্ন মেধার ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রবেশ ঘটছে যা সার্বিক বিচারে ভালো স্কুলের মান নিম্নমুখী করছে।

 

আমাদের দেশে প্রতিটি সরকারই ক্ষমতা গ্রহণের পর বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ছাড়া স্বল্প মেয়াদে আশানুরূপ ফল পাওয়ার অভিপ্রায়ে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ উদ্যোগ উদ্দেশ্যমূলক হওয়ায় সুদূরপ্রসারী ফল প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, গতিশীল, যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন মেধাবীদের উপযুক্ত বেতনভাতা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা। পাশাপাশি অবৈতনিক ও বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের সুযোগ এমনভাবে সীমিত করা, যাতে দেশ কাঙ্খিত লক্ষ্যে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতই যারা শিক্ষার ব্যয় ও পাঠ্যপুস্তক ব্যয় নির্বাহে অক্ষম কেবল তারাই যেন এর অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর