শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই একটি আলাদা বাহিনী গঠন করা যায়

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমানের লেখা মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেয়ার কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। কিছু কিছু ঘটনা আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই দিনের সেই সব ঘটনা ভুলতে পারি না।

মুক্তিযুদ্ধকালে আমার একটি স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে : ত্রিপুরার মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হায়দার নারায়ণগঞ্জের অনেক ছাত্র-যুবকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের প্রশংসা করতে গিয়ে আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ইসমাইল মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তোমাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে এত লোক মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিতে আসছে যে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই একটি আলাদা বাহিনীর গড়ে তোলা যায়। ক্যাপ্টেন হায়দারের এই প্রশংসা শুনে আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ইসমাইল হোসেন অত্যন্ত গৌরবোধ করেন।

 

ইসমাইল ভাই মুগ্ধ হয়ে ক্যাপ্টেন হায়দারের দিকে কিছুক্ষণ হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। আমরা ইসমাইল ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন হায়দারের সেই কথার গৌরবের স্পর্শ পাই। আজ মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরও ক্যাপ্টেন হায়দারের সেই কথা আমার কানে বাজে এবং সে কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজেকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে হয়। আজ আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ইসমাইল ভাই আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে সেই গৌরব আরো বেশি করে আমরা উপভোগ করতে পারতাম।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আগরতলার আরো একটি ঘটনা আমি এখনো ভুলতে পারিনা। তা হচ্ছে আমাদের জন্য নারায়ণগঞ্জের তখনকার এমপি এবং নারায়ণগঞ্জের অবিসংবাদিত নেতা এ কে এম শামসুজ্জোহার স্নেহ-ভালবাসা। আমি মেলাঘর ক্যাম্প থেকে মাঝে মাঝে আগরতলায় জোহা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ছাত্রলীগ করার কারনে তিনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। একদিন জোহা সাহেবের সঙ্গে দেখা করার সময় তিনি আমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বললেন, তোমরা ক্যাম্পে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারো না, অনেক কষ্ট করছো তোমরা, আমার খুব খারাপ লাগে। এই ১০০ টাকা নাও, যখন মন চায়, বাইরে ভাল কিছু খেয়ে নিও। আর ক্যাম্পে কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে, আমি সমাধান করার চেষ্টা করব। আমাদের এমপি শামসুজ্জোহা সাহেবের সেই কথা শুনে আমরা অনেক আশ্বস্ত হয়েছিলাম। এ জন্য তার কথা এখনো ভুলতে পারিনা।

 

পরে একদিন জোহা সাহেব আমাদের মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে এসে আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে আমরা কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হয়েছিলাম, আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিল নারায়ণগঞ্জের। অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে জোহা সাহেব আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানানোর পাশাপাশি আমাদের থাকা খাওয়ার কষ্টের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং বলেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে আমাদের সবার কষ্ট দূর হয়ে যাবে। তোমরা কষ্ট করছ কিন্তু একদিন এই কষ্টের জন্য সুফল আমরা সবাই পাবো। তার সেই কথা শোনার পরে সেখানে সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। এখনো এটিএম শামসুজ্জোহার সেই বক্তৃতা আমার মনে আছে।  

 

১৯৭১ সালে আমি গোদনাইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরুর পর ১৯৬৬ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ি। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তার প্রতিটি আন্দোলনেই আমি সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। পাকিস্তান বাহিনী ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে ২৭ শে মার্চ। যদিও নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তান বাহিনীকে ২৭ শে মার্চ প্রতিরোধ করা হয়েছিল এবং শহরে পাকিস্তান বাহিনী ২৮ শে মার্চ নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে পেরেছিল।

 

আমরা ছাত্র জনতা পাক বাহিনীকে আমাদের এলাকায় যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য গাছ কেটে বার্মাশেল তেল ডিপোর রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিলাম। পাকিস্তান বাহিনী বার্মাশেল তেল ডিপোতে ক্যাম্প করে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে এলাকার বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তান বাহিনী চরম অত্যাচার নির্যাতন করে এবং আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমাদের বাড়ি ছিল বার্মাশেল ডিপোর খুবই কাছে। বাড়িঘর হারিয়ে আমরা জালকুড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। 

 

আমাদের এলাকার বড় ভাই ইসমাইল ভাই তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই তিনি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যোগ দেয়ার জন্য আগরতলায় চলে যান। আগরতলায় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তিনি আবার আমাদের এলাকায় ফিরে আসেন এবং এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য মোহর ভাইসহ আরো বেশ কয়েকজনকে নিয়ে আগরতলা নিয়ে যান। এভাবে তাকে সিদ্দিরগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি আগরতলা থেকে এসে এলাকায় কিভাবে কি অপারেশন করা যায় তার পরিকল্পনা করেন এবং এর পাশাপাশি এখান থেকে যুবক ছাত্রদেরকে নিয়ে আগরতলা ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে দিয়ে আসতেন।

 

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ করতে থাকেন। একদিন আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা দুর্ধস্য রাজাকার কাশেম রাজাকারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। আব্দুল মজিদ সাউদ ভাই ও তাজুল ইসলাম কেতা  কাসেম রাজাকারকে হত্যা করার জন্য অপারেশনে যান। তখন আমি সেই অপারেশনে তাদের সাথে  ছিলাম। অপারেশন শেষ হওয়ার পর আমরা কদমতলির এমডব্লিউ স্কুলের এলাকা থেকে দ্রুত পালিয়ে জালকুড়ি চলে যাই। সেই অপারেশনের পর আমি অনুভব করলাম এবার অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যাওয়া উচিত।

 

ইসমাইল ভাই ভারত থেকে এসে তখন ভুইগড়ে অবস্থান করছিলেন। আমি তার সাথে দেখা করতে ভুইঘর যাই এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানাই। এরপর ইসমাইল ভাই তৃতীয় দফা যখন আগরতলা যান তখন আমি তার সঙ্গী হই। আমাদের সাথে আরো কয়েকজন ছিলেন। আমি সঙ্গে কয়েকশো টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা লক্ষণখোলা ও লাঙ্গলবন্দ হয়ে বৈদ্যেরবাজার যাই। সেখান থেকে নৌকায় বাঞ্ছারামপুর যাই। সেখান আমরা আরো অনেক লোককে পাই যারা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য সেখানে সমবেত হয়েছিলেন।

 

এরপর সবাই মিলে একসাথে কখনো হেঁটে কখনো নৌকায় ত্রিপুরা সীমান্তে পৌঁছি। ত্রিপুরায় প্রবেশ করার পর আমরা গিয়ে উঠি হাঁপানি ক্যাম্পে। সেখানে বেশ কিছুদিন থাকার পর আমাদেরকে পাঠানো হয় মেলাঘর ক্যাম্পে। পাহাড়ের উপরে মেলাঘর ক্যাম্পে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ ও ক্যাপ্টেন হায়দার। ইসমাইল ভাই আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে সেই ট্রেনিং ক্যাম্পে যান। তখন ক্যাপ্টেন হায়দার মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করছিলেন।

 

ইসমাইল ভাইকে ক্যাপ্টেন হায়দার আগে থেকেই চিনতেন। ইসমাইল ভাই নারায়ণগঞ্জ থেকে এর আগেও একাধিকবার অনেক ছাত্র যুবককে নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণের নাম লিখিয়ে দিয়েছেন সেটা ক্যাপ্টেন হায়দারের জানা ছিল। তৃতীয়বার এসে ইসমাইল ভাই আমাদেরকে নিয়ে ক্যাপ্টেন হায়দারের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমাদের ক্যাপ্টেন হায়দার জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কোত্থেকে এসেছো? ইসমাইল ভাই বললেন, এরা সবাই নারায়ণগঞ্জের ছেলে। তখন ক্যাপ্টেন হায়দার মুচকি হেসে বললেন, নারায়ণগঞ্জের এত ছেলে মুক্তিযুদ্ধে আসছে যে তাদের দিয়েই আলাদা একটি বাহিনী গঠন করা যায়। ক্যাপ্টেন হায়দারের এই প্রশংসা শুনে ইসমাইল ভাই অত্যন্ত খুশি হলেন, তার পিছনে দাঁড়িয়ে আমরাও সেই প্রশংসার গৌরব অনুভব করলাম।

 

মেলাঘরে পাহাড়ের উপর একটি ট্রেনিং ক্যাম্পে আমাদের ১০ দিনের কঠোর অস্ত্রপ্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তখনকার ইপিআর থেকে বেরিয়ে আসা একজন সৈন্য আমাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। কিভাবে বন্দুক, এসএলআর, মেশিনগান চালাতে হবে তা আমাদের বিশদভাবে বুঝিয়ে এবং হাতেনাতে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। এত সুন্দর ভাবে তিনি আমাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছিলেন যে আমরা তার প্রশিক্ষণে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আমাদেরকে বাংলাদেশে  চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং বলা হয় এলাকায় গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করতে হবে।

 

আমরা যেভাবে গিয়েছিলাম সেভাবেই ইসমাইল ভাইয়ের নেতৃত্বে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসি। বাংলাদেশে ফিরে আসার সময় আমাদের অনেক বিপদ সংকুল পথ দিয়ে আসতে হয়েছে। এত বছর পরও আমার মনে হলে গা শিউরে উঠে যে, ভারী গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে আমি কয়েক কিলোমিটার পথ পানিতে তলিয়ে থাকা বিলের জমির উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়েছি। আমার সাথে তখন দলের সবাই ছিলেন। গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে আসা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু যেহেতু দেশকে স্বাধীন করাই আমাদের ছিল মূল লক্ষ্য তখন এই গুলির বোঝা মাথায় নেয়ার কষ্ট কোন কষ্টই মনে হয়নি।

 

এরপর আমরা বিভিন্ন পথ ঘুরে কখনো নৌকায় কখনো হেঁটে দুই নম্বর গুদারা  ঘাটে এসে আমরা ভয় পেয়ে যাই। এত অস্ত্র নিয়ে আমরা কিভাবে জালকুড়ি যাব। আমি লক্ষণখোলা থেকে এক বান্ডেল (আটি) পাটখড়ি (সোলা) নিয়ে তার ভিতরে আমার এসএলআর ঢুকিয়ে ঢেকে রাখি। সবাই দেখে মনে করে যে পাটখড়ির আটি নিয়েই যাচ্ছি। এভাবেই আমরা আমাদের অস্ত্র এবং গুলি নিয়ে আমরা জালকুড়িতে চলে যাই। এরপর বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে থাকি।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর