শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যকে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে বাধ্য করেছিলাম

বীর মুক্তিযোদ্ধা এহসান কবীর রমজান

প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা এহসান কবীর রমজানের লেখা এক পাকিস্তানী সৈন্যকে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে বাধ্য করার কাহিনী।  

 

 

মুক্তিযুদ্ধে আমার একটি স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে, আমরা একজন পাকিস্তানি সেনাকে ধরে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে বাধ্য করতে পেরেছিলাম। সে শুধু জয়বাংলা শ্লোগানই দেয়নি, বঙ্গবন্ধু ও ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামেও শ্লোগান দিতে বাধ্য হয়েছিল। সেই সময়ে এ কাজটি করতে পেরে আমরা অনেক গৌরববোধ করেছিলাম।

 

 

আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে সেই কথা মনে হলে আমাদের মনটা আনন্দে ভরে যায় এ কারনে যে, যেই পাকিস্তানীরা আমাদের ধ্বংস করার জন্য দীর্ঘ ৯ মাস এই দেশে গণহত্যা চালিয়েছে সেই পাকিস্তানীরাই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে বাধ্য হয়েছিল।

 

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। তখন আমরা শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সাথে জড়িত ছিলাম। এছাড়াও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবেও কাজ করতাম।  

 

 

একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে সেই ভাষণ শোনার। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো শুনে আমাদের অনেকেরই রক্ত টগবগ করে উঠেছিল। তিনি সেই দিন বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে সবার ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি পরোক্ষ নির্দেশ ছিল বলে আমাদের মনে হয়েছিল।

 

 

২৫ শে মার্চ এ যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা এবং দেশের সকল মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশের পর নারায়ণগঞ্জে আমাদের গ্রামে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে, আমাদের মধ্য থেকে চারজন রাজনৈতিক কর্মী যারা আমাদের নেতার অবস্থানে ছিলেন, তারা এলাকায় নেই।

 

 

তারা হলেন শ্রমিক নেতা আশেক আলী মাস্টার, ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন, খেলাঘর সংগঠক আবদুল আজীজ এবং ন্যাপ নেতা আবদুস সোবহান। তাদের খুঁজতে গিয়ে জানা গেল তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আগরতলায় চলে গেছেন। এই চার নেতা মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা চলে যাওয়ার খবর শুনে আমাদের অনেকের মধ্যে আগরতলা যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে।  

 

 

একদিন আমাদের বাড়ির কিছু চাল আমি গোদনাইল বাজারে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হাতে পেলাম। সেই টাকা নিয়েই আমি সবার অগোচরে একাই আগরতলার পথে রওনা হলাম। কিভাবে যাব, কোথায় যাব, কোন পথ দিয়ে যাব, কিছুই জানি না। গোদনাইল থেকে প্রথম লক্ষণখোলা হয়ে সোনারগাঁয়ে যাই, সেখান থেকে লঞ্চে রামচন্দ্রপুর গিয়ে নামি। রামচন্দ্রপুরে একদিন থাকার পরে লঞ্চঘাটে দেখি আমাদের এলাকার ছাত্রনেতা মতিন ভাই লঞ্চ থেকে নামছে।

 

 

তার কাছ থেকে শুনলাম তিনি আগরতলায় একবার ট্রেনিং নিয়ে  গ্রামে ফিরে এসে কয়েকজন তরুণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে মতিন ভাই বললেন, তুই এখানে কেন? আমি বললাম, আগরতলা যাব যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। মতিন ভাই বললেন, তোর বয়স কম তোকে মুক্তি দিতে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তুই বাড়ি ফিরে যা। আমি বললাম, আপনারা আমাকে না নিলে আমি একাই যাব। আমি নাছোড়বান্দা বুঝতে পেরে মতিন ভাই আমাকে তাদের সাথে আগরতলা নিয়ে যেতে রাজি হলেন।

 

 

আমরা আগরতলায় গিয়ে সেখানকার আর্ট কলেজের হোস্টেলে উঠি। সেই হোস্টেলকে সবাই ক্রাফট্স হোস্টেল বলতো। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর আমাদের  অস্ত্র প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য প্রথম বদদোয়ালি এবং আগরতলা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে পঞ্চবটি নামক একটি স্থানে পাঠানো হয়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

 

 

সেই ক্যাম্পে আমাদের ১৫ দিনের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই ক্যাম্পে একইসঙ্গে আলী হোসেন( পরে আমাদের গ্রুপ কমান্ডার) ভাই, আব্দুল মতিন, খোরশেদ আলম, জয়নাল আবেদিন, রওশন আলী প্রমুখ অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ নেয়ার পরে আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে আসি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।

 

 

দেশে এসে আমরা বেশ কয়েকটি অপারেশন করি। তার মধ্যে ছিল কয়েকটি ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা, বেশ কয়েকটি রেলসেতু ধ্বংস করে দেয়া ইত্যাদি।

 

 

এভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কাটতে থাকে। এরই মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর এসে যায়। সেদিন সকালের দিকে খবর পেলাম ভারতীয় বাহিনী লক্ষণখোলা দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে আমাদের এলাকায় ঢুকছে। এ খবর পেয়ে আমরা তিনজন মুক্তিযোদ্ধা- আমি, খোরশেদ আলম ও আয়েত আলী গাজী দৌড়ে চিত্তরঞ্জন গুদারা ঘটে  যাই ভারতীয় সেনাদের সৈন্যদের দেখার জন্য।

 

 

সেখান থেকে গোদনাইলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশনের পাশ দিয়ে ফেরার সময় একটি ছেলে দৌড়ে এসে আমাদেরকে খবর দিল যে, জেএমসির ভিতরে এখনো পাকিস্তানী সৈন্যরা গোলাগুলি করছে। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানিদের পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। এরপর আমরা কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে জেএমসির ভিতরে গিয়ে দেখি একটি ভবনের দোতলায় পজিশন নিয়ে  পাকিস্তানি সৈন্যরা অনবরত গুলিবর্ষণ করছে।  

 

 

আমরা সাবধানে নিচ তলার সিঁড়ি দিয়ে ক্রলিং করে একটু উপরে উঠেই কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারলাম পাকিস্তানী সৈন্যদের দিকে। আমি গ্রেনেড খোরশেদ ভাইয়ের হাতে দেই আর সে তা পাকিস্তানীদের দিকে ছুড়ে মারতে থাকে। এভাবে আমরা প্রায় ৮/১০টি গ্রেনেড ছুড়ে পাকিস্তানীদের কাবু করে ফেলি।

 

 

এদিকে গোলাগুলির শব্দ শুনে ভারতীয় সৈন্যরা সেখানে চলে আসে। ভারতীয় সৈন্যদের দেখে পাকিস্তানিরা আবার গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন ভারতীয় সেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। ভারতীয় সৈন্যরা হ্যান্ড মাইকে পাকিস্তানের সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়।

 

 

কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ থেকে আর কোন সারা শব্দ না পেয়ে ভারতীয় সৈন্যরা মনে করে পাকিস্তানিরা নিহত হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের বলে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তোমরা এখন যার যার বাড়িতে চলে যাও। এ কথা বলে ভারতীয় সৈন্যরাও ঢাকার দিকে চলে যেতে শুরু করে। আমরা আমাদের গোপন আস্তানা জালকুড়িতে চলে আসি।

 

 

পর দিন সকালে আমরা আবার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে যাই। দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাকিস্তানি সৈন্যদের কোন সাড়া-শব্দ নেই। আমরা অস্ত্র তাক করে দোতালায় সিঁড়িতে গিয়ে দেখি বাথরুমের ভিতরে এক পাকিস্তানী সৈন্য হাত তুলে আত্মসমর্পন করতে চাচ্ছে।  সে জানায়, তার দুই সহযোগী রুমের ভিতর আছে। আমরা রুমের ভেতরে উকি দিয়ে দেখি, দুই পাকিস্তানী সৈন্য রুমের ভিতরে মরে পড়ে আছে। আমরা জীবিত সৈন্যকে ধরে টেনে নিচে নিয়ে আসি। দুই পাকিস্তানীর  লাশ নদীতে নিয়ে ফেলে দেয়ার জন্য জেএমসির সুইপারদের  নির্দেশ দেই।

 

 

পরে আত্মসমর্পণ করা সৈন্যকে নিয়ে আমরা হেঁটে জালকুড়ির দিকে যেতে থাকি। শতশত মানুষ আমাদের সাথে হাঁটতে থাকে। আমরা ২নম্বর বাসষ্ট্যান্ডে আসার পর এলাকার এক মুরুব্বী মফিজউদ্দিন সরদার আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে তার পায়ের স্যান্ডেল খুলে সেই পাকিস্তানি সৈন্যটির গালে দুইবার আঘাত করে। তিনি বলেন, আমার প্রতিজ্ঞা ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে পেলে আমি জুতাপেটা করব, আমার সেই সাধ এখন পূর্ণ হলো।

 

 

এদিকে শত শত মানুষ যারা আমাদের সাথে হেঁটে যাচ্ছিল তারা জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমরা পাকিস্তানী সৈন্যকে বললাম, জয়বাংলা স্লোগান দাও। সে জোরে জয়বাংলা স্লোগান দিতে শুরু করল। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যকে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গার্ন্ধীর নামে শ্লোগান দিতে বললে সে তাদের নাম ধরে ম্লোগান দেয়।

 

 

দীর্ঘ ৯ মাস ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদেরকে হত্যা করার জন্য যুদ্ধ করছিল আর আমরা জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলাম। সেই পাকিস্তানিরা এখন আমাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যের মুখে এভাবে জয়বাংলা স্লোগান শুনে আমাদের আনন্দ আরো বেড়ে গিয়েছিল। সেই দিন রাতেই জালকুড়িতে সেই পাকিস্তানি সৈন্যকে গুলী করে মেরে ফেলা হয়।  এখনো আমাদের ভাবলে আনন্দ লাগে যে, আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজিত করে তাদের মুখে জয়বাংলা স্লোগান দিতে বাধ্য করতে পেরেছিলাম। এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর