শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অপারেশনের স্মৃতি ৫০ বছর পরও অমলিন

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ৬ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ে মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলামের লেখা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অপারেশনের কাহিনী।  

 

 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হলেই অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে শ্রেষ্ঠ ঘটনা। এই দেশে, এই উপমহাদেশের কোন দেশের ইতিহাসেই মুক্তিযুদ্ধের মত এত বড় এবং গৌরবময় ঘটনা আর ঘটেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন ছিল।

 

 

সেই স্বপ্ন একাত্তর সালে এসে সফল হয়েছে এবং সেই সফল হওয়ার পিছনে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে পেরেছি - এটা আমাদের জীবনের একটি সৌভাগ্য, গৌরবময় ঘটনা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, আমাদের সন্তানরা, আমাদের বংশধররা এই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গৌরববোধ করে। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে অংশ গ্রহন করতে পেরেছিলাম সেটাই আমাদের জীবনের পরম সার্থকতা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম : ৭১ সালে আমি ছিলাম গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। থাকতাম আদমজীনগরের কদমতলীতে। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন ছাত্র রাজনীতির প্রতিও ঝোঁক ছিল, যদিও প্রত্যক্ষভাবে ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নেইনি। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির খোঁজখবর রাখতাম, কারণ আমার সহপাঠিরা অনেকেই তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন।

১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স মাঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পরই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের সামনে কঠিন সময় আসছে, সে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ’৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সৈন্যরা যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে তখনই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং দেশবাসীকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের কারণেই পুরো বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তখন আমাদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের অংশ নেয়ার আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল। তারই ফল হিসেবে আমরা দলবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা চলে যাই। আগরতলায় যেতে আমাদের যে কষ্ট হয়েছিল তা এতদিন পরে মনে হলেও মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তখন কোন কষ্টই আমাদের কষ্ট মনে হয়নি, কারণ তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়াই আমাদের স্বপ্ন ছিল।
আগরতলা যাওয়ার আগে আমাদের সিনিয়র কয়েকজন নেতা আমাদের বললো, তোমরা যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাও এবং তোমরা যে আওয়ামী লীগের সমর্থক তা প্রমান করা জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে। আমরা কয়েকজন মিলে- আমি, হাসমত, কাইজুদ্দিনসহ আরো কয়েকজন মিলে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল ভাইয়ের কাছে যাই। তিনি আমাদের কথা শুনে নিশ্চিত হলেন, আমরা আসলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চাই। তখন তিনি আওয়ামী লীগের প্যাডে একটি চিঠি লিখে দিলেন যে, আমরা তার পরিচিত, আদমজী এলাকার ছেলে এবং আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্যই ভারতে যাচ্ছি। সেই চিঠি নিয়ে আমরা জুলাই মাসের কোন একদিন আদমজী থেকে আগরতলার দিকে রওনা হই। আমরা প্রথমে আখাউড়া যাই। পরে হেটে দুলালপুর হয়ে  ত্রিপুরায় ঢুকে যাই।

আগরতলায় আমাদের প্রথম ঠিকানা ছিল কংগ্রেস ভবন। সেখানে গিয়ে আমরা বাংলাদেশের অনেক লোক পেয়ে যাই। তাদের সাথে আগরতলা শহরের বাইরে হাঁপানিয়া এলাকায় বাংলাদেশীদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পে যাই। হাপানিয়া ক্যাম্পে গিয়ে আমরা আমাদের এলাকার আরো অনেক লোক এবং ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের পেয়ে যাই। তারা আমাদের সাদরে গ্রহণ করে। এরপর সেখান থেকে আমাদের চড়িলাম নামক একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষণের ক্যাম্প ছিল। আমরা সে ক্যাম্পে যোগ দিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সে ক্যাম্পে রাজনৈতিক নেতা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাঙালি সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধ করতে হলে আমাদের কি কি করতে হবে তার দিকনির্দেশনা দেন ।

প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা তখন  বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি।

আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সেই সময়ই হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের আগের একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করার সময় কুমিল্লার বেতিয়ারা গ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে নয় জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সে যুদ্ধে গোদনাইল হাই স্কুলে আমাদের সিনিয়র ছাত্র সহিদুল্লাহ সাউদ এবং লক্ষ্মখোলার আওলাদ হোসেনও শহীদ হন। সে খবর শুনে আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি।  এই খবর আগরতলায় ছড়িয়ে পড়ার পর আমাদের বাংলাদেশের প্রবেশ করার দিন পিছিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর আমাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হবে। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর আমরা প্রায় অস্থির হয়ে পড়লাম, কত দ্রুত আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করব তার জন্য সবাই ছটফট করতে থাকি ।

এ প্রেক্ষাপটে একদিন আমাদের নির্দেশ দেয়া হলো তোমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যুদ্ধের মাঠে চলে যাও। আমরা নোয়াখালী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। আমাদের সাথে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রায়পুরা, কুমিল্লা এবং নোয়াখালীর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা নোয়াখালী প্রবেশ করে গুণবতী রেলস্টেশনে অবস্থান নেই। সেখানে তখন পাকিস্তানি কোন সৈন্য ছিল না। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের হামলার ভয়ে পিছিয়ে চৌমুহনীতে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নিলেন চৌমুহনীতে পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে আক্রমণ করা হবে। সেখানে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হবে। যদি আত্মসমর্পণ করতে না চায় তাহলে সবাইকেই মেরে ফেলা হবে।

আমরা সবাই প্রস্তুতি নিলাম যার যার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। এক পর্যায়ে আমরা চৌমুহনীতে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প চারদিক থেকে ঘিরে ফেললাম। তখন সেখানে অন্য এলাকা থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা চলে এসেছেন। আমাদের দেখেই পাকিস্তান বাহিনী প্রচন্ড গুলীবর্ষণ শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলীবর্ষণ করি। দুই পক্ষে দীর্ঘ সময় গোলাগুলি চলার পর পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে নিহত হয়। তবে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। তাদের সবাইকে আমরা ধরতে পারিনি। কয়েকজনকে ধরা হয়েছিল, তাদেরকে সাথে সাথেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মেরে ফেলা হয়।

আমরা বিজয় অর্জন করার পর বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে আমাদের ঘিরে ধরে জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। আমাদের খুব ভালো লাগে যে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেই পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি। সেই আনন্দের আর সাফল্যের অনুভূতি ৫০ বছর পরেও ভুলতে পারিনি।

এরপর আমরা ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখন কোন গাড়ি ছিল না। আমরা পায়ে হেঁটেই ফেনীর দিকে রওনা হই। ফেনীতে এসেও কোন যানবাহন না পেয়ে সেখান থেকে আবার হেঁটে কুমিল্লা পর্যন্ত আসি। কুমিল্লা এসে আমরা একটি বড় নৌকা পেয়ে যাই। সেই নৌকায় সব মুক্তিযোদ্ধা উঠে আমরা ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। এরপর আমাদের পুরো মুক্তিযোদ্ধা দলটি নরসিংদীতে এসে পৌঁছি। তখন নরসিংদীতে অন্যান্য এলাকা থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা এসে সমবেত হয়েছিল।

ইতিমধ্যে ডিসেম্বর মাসের কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে নরসিংদীতে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারত থেকে আগত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য এবং অফিসাররাও নরসিংদীতে এসে পৌঁছেছেন। এসময় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল একটি দল ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে এবং ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ করবে। সবাই ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি।

আমাদের কমান্ডারের নির্দেশে আমরা সবাই ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে শুনতে পাই যে, ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে। যেকোন সময় তারা আত্মসমর্পণ করবে। সবার মধ্যে আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করে আমাদের নিজ এলাকা আদমজীতে চলে আসি। আদমজীতে এসে আমরা আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে পেয়ে যাই। তারা বিভিন্ন পথে ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছেছিল।

দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেল। আমরা এখন প্রবীণ হওয়ার পথে। কিন্তু এই বয়সেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন ভাবি তখন আমাদেরকে তরুণ মনে হয়। মনে হয় এইতো সেদিন আমরা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিলাম, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলাম এবং যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করলাম।

আজ এত বছর পর সেই সময়ের কথা মনে হলে আসলেই বুক ভরে যায় গৌরবে। আমরা এই দেশের সূর্যের সন্তানরা যুদ্ধ করেছিলাম বলেই আজ আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কথা মনে করে গৌরববোধ করবে যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য এই স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছে।এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর