বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১২ ১৪৩১

ফের গ্রুপিং-দ্বন্দ্বে বিএনপি

লিমন দেওয়ান :

প্রকাশিত: ১১ নভেম্বর ২০২৪  

গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণভুত্থানের রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ লাপাত্তা। যার প্রেক্ষিতে টানা ৩ মাস যাবৎ নেই কোন হামলা, মামলা আর গ্রেফতারের ভয়। প্রতিপক্ষবিহীন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন নির্ভয়ে রাজনীতির মাঠে রয়েছে জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তা ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিভিন্ন নেতার নেতৃত্বে এলাকায় এলাকায় চলছে মহড়া-শোডাউন। এদিকে মাঠ ফাঁকা পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির মাঠে এখন বিএনপির প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে বিএনপিই।

 

এদিকে জেলা ও মহানগর বিএনপিসহ বিভিন্ন উপজেলা ও যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষকদলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন করছেন বিভিন্ন নেতার অনুসারীরা। তা ছাড়া বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরে বিলুপ্ত হয়ে পরেছে জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি। এদিকে বর্তমানে বিএনপির পরিস্থিতির সঙ্গে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে দলের অভ্যন্তরীন কোন্দাল (গ্রপিং)।

 

সূত্র বলছে, জেলা বিএনপির নয়া কমিটি গঠনের পর থেকেই জেলা বিএনপির মূল ব্যানারে গিয়াস উদ্দিন ও গোলাম ফারুক খোকনকে দেখা গেলে গত ৮ নভেম্বর ঢাকায় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে র‌্যালী অনুষ্ঠিত হলে সেখানে জেলা বিএনপির ব্যানারে পিছনে দেখা যায় জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীবকে ব্যানারের পিছনে দেখা যায়নি সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকনকে। তাকে দেখা গেছে রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ব্যানারের পিছনে। যার ফলে জেলা বিএনপিতে দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে যাচ্ছেন খোকন সেটাই প্রমানিত। 

 

এদিকে ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির ৪১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। যেখানে আহ্বায়কের দায়িত্ব পান এড. সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিবের দায়িত্ব পান এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু। তাদের নেতৃত্বকে অযোগ্য আখ্যায় দিয়ে কমিটিতে স্থান পাওয়া ৪ জন যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যসহ ১৫ জন কমিটি থেকে বিদ্রোহ করেন। এর পর থেকেই মহানগর বিএনপি দুইভাবে বিভক্ত হয়ে পরেন। দুই গ্রুপ আলাদাভাবে কমিটি হওয়ায় পর টানা ৩/৪ মাস আলাদা ব্যানারে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে শুরু করে ইউনিট ভিত্তিক পাল্টা কমিটি গঠনের মতো ঘটনা ঘটে। এর পরপরই হঠাৎ নিস্কিয় হয়ে পরেন বিদ্রোহ কমিটি।

 

কিন্তু গত ৫ আগষ্টের পর আবারো মহানগর বিএনপির আলাদা ব্যানারে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুই গ্রুপই। এদিকে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে বন্দর উপজেলা, বন্দর থানা, সদর থানা, ১৪ নং ওয়ার্ড বিএনপিসহ কয়েকটি কমিটি মূল কমিটির সাথে পাল্টাভাবে করা হয় যা বর্তমানে ও বহাল রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ফতুল্লা থানা বিএনপির রাজনীতি। গত ২০২৩ সালে ফতুল্লা থানা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনে অনেকটাই উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। 

 

কিন্তু ১৬ জুন থানা বিএনপির সম্মেলনের পর থেকেই গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব শুরু হয় সংগঠনটিতে। যা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ চলমান রয়েছে কমিটি। সম্মেলনের পর থেকেই ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটু, সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন মোল্লা ও অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক এড. বারী ভূঁইয়া, সিনিয়র সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ মোল্লা এক গ্রুপ। উভয় পক্ষই জেলা বিএনপির নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন থাকলে ও গত ৫ আগষ্ট পট পরিবর্তনের পর থেকেই ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটু, সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন মোল্লার এই গ্রুপটি পুরোই আলাদা হয়ে পরে। এরা রিয়াদ মুহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে থেকে জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াস উদ্দিনের বিরোধীতা শুরু করেন। এদিকে গত ৭ নভেম্বর ফতুল্লা থানা বিএনপির আয়োজিত একটি পোগ্রামে রিয়াদ চৌধুরী প্রকাশ্যে গিয়াস উদ্দিনের বিরোধীতা করেন এমনকি তাকে গডফাদার শামীম ওসমানের সাথে মিলিয়ে নানা বক্তব্যে রাখেন যা নিয়ে আবারো উত্তাপ ছড়িয়ে পরে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতিতে।

 

সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপিকে ঘিরে রয়েছে নানা সমালোচনা এই থানা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান যিনি পটপরিবর্তনের পর থেকে সোনারগাঁ এর ত্রাস হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। বর্তমানে মান্নান ও রেজাউল গ্রুপ দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে স্বগরম সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির রাজনীতি। একই সাথে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপি জুড়ে বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান সুমন এই গ্রুপ মনোনয়ন যুদ্ধে ইতিমধ্যে ৫ দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। 

 

এদিকে আড়াইহাজার বিএনপির ব্যানারের আলাদাভাবে নিয়মিতই শোডাউন ও বিভিন্ন কর্মসূচি লক্ষ্য করা যায়। রূপগঞ্জে একইভাবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু ও নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজাম্মান মনিরের দুই গ্রুপের নেতৃত্বে রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নামে আলাদাভাবে দুই ব্যানার পরিচালিত হয়। এই উপজেলায় ও দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে কিছুদিন পরপই উভয় পক্ষের অঙ্গসংগঠনের কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।

 

তা ছাড়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই পক্ষ দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের হেয় করার মতো ঘটনা দৃশ্যমান। সিদ্ধিরগঞ্জ জুড়ে রয়েছে নানা সমালোচনা যেখানে জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ্ব মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মামুন মাহমুদ দুই গ্রুপের বেড়জালে সিদ্ধিরগঞ্জের দ্বন্দ্ব সকল উপজেলার মতোই প্রকাশ্যে।  গত বছরের ২৯ আগষ্ট জেলা যুবদলের ৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই একত্রিত হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি কমিটির আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক, সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক খাইরুল ইসলাম সজীবকে। একই সংগঠনে থাকা সত্ত্বে ও জেলা যুবদলের আলাদা ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও এক করতে পারেনি তাদের। 

 

একই দিনে নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের ৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পরপরই কমিটিতে সভাপতি পদপ্রার্থী হয়ে ও স্থান না পাওয়া সাবেক ছাত্রনেতা মাহজারুল ইসলাম জোসেফের নেতাকর্মীরা ক্ষোভে মহানগর বিএনপির দলীয় কর্মসূচিস্থলে হামলা চালায়। এই লঙ্কাকাণ্ডের মাধ্যমে শুরু থেকেই মহানগর যুবদল দুইভাবে তা প্রকাশ পায়। একই সাথে কমিটিতে সদস্য সচিবের পদ চেয়ে ও না পেয়ে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া সাগর প্রধান কিছুদিন সংগঠনের কার্যক্রম থেকে নিস্কিয় হয়ে পরলে ও মনে ক্ষোভ রেখে হলে ও মহানগর যুবদলের কমিটির বাকি দুইজনের সাথে একত্মতা প্রকাশ করেন। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পরপরই গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষের র‌্যালিতে মহানগর যুবদল তিনভাবে বিভক্ত দেখা যায়। সেখানে মূল কমিটির সাথে বিদ্রোহ করে মহানগর যুবদলের ব্যানারে আলাদা কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় সাগর প্রধানকে যার মাধ্যমে সংগঠনে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়। 

 

এদিকে গত বছরের ২৯ আগষ্ট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন হলে ও একত্রিত হতে দেখা যায়নি কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব হোসেন, সদস্য সচিব সালাউদ্দিন সাল্লু, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রফিককে। সাল্লু-রফিক হাটেঁ যে পথে মাহবুব হাটেঁ তার উল্টো পথে। বর্তমানে দলীয় কর্মসূচিতে মাহবুব আলাদাভাবেই জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন। অন্যদিকে সাল্লু ও রফিক আলাদা ব্যানারে কর্মসুচি পালন করেন। প্রতিটি সংগঠনে এমন গ্রুপিং দ্বন্দ্বে পরিচয়বিহীন হয়ে রয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনে স্থান পেতে চাওয়া যোগ্য বহু নেতাকর্মীদের স্থান হচ্ছে না। হচ্ছে না ইউনিট কমিটি হয় না কমিটি পূর্ণাঙ্গ। এছাড়া বর্তমানে তাদের এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পরেছে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে। 

 

এদিকে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর জেলা কৃষকদলের দায়িত্ব পান আহ্বায়ক ডা. শাহীন আহম্মেদ ও সদস্য সচিব কায়সার রিফাত। এর পর দুই নেতার ঐক্যবদ্ধতায় ইউনিট কমিটি ও নিজেদের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়। কিন্তু গত ৫ আগষ্টের পর থেকেই শাহীন ও রিফাতের মাঝে অনৈক্য দেখা গেলে ও যা গত ৮ নভেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রীয় ঘোষিত কর্মসূচিতে জেলা কৃষকদলের আলাদা ব্যানারে কর্মসূচি পালনের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ পায়। এমন করে একে একে বিভিন্ন গ্রুপ ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। যাকে এই গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব আগামী দিনের রাজনীতিতে আঘাত আনতে পারে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

এই বিভাগের আরো খবর