রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪   ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

বন্দরের নাসিক এলাকায় পানির জন্য হাহাকার

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১ মে ২০২৩  

 

# এখানকার পানির লাইন মাঝে মাঝে ঠিক হয় : এলাকাবাসী
# জনসাধারণকে রাত জেগে পানি সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় থাকতে হয়
# দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায়ও কর্তৃপক্ষের নির্বিকার ভূমিকায় এলাকাবাসী হতাশ
# ৯ মাস আগে নষ্ট হওয়ার পরই লিখিতভাবে জানিয়েছি : পাম্প অপারেটর
# দ্রুত সমস্যাটি সমাধানে আলাপ আলোচনা চলছে : কাউন্সিলর আফজাল

 

 

পানি পান করা থেকে শুরু করে গোসল করা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রের পানির ব্যবহারের জন্যই নির্ভর করতে হয় ওয়াসা বা সিটি কর্পোরেশনের সরবরাহ করা পানির উপর। তাই বছর, মাস কিংবা দিন কেন পানি ছাড়া একটি মিনিটও কল্পনা করা যায় না। অথচ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) বন্দর এলাকায় এই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যা চলছে বছর পর বছর জুড়ে। কোন কোন ওয়াসার পাম্প প্রায় বছর জুড়েই অকেজো হয়ে থাকে, অথচ সেগুলো মেরামতে নাই কোন উদ্যোগ।

 

এখানে অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে শোনা যায় নাসিকের পানি সরবরাহ মাঝে মাঝে ঠিক হয়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই থাকে অকেজো। তাই এই এলাকার জনসাধারণকে রাত জেগে পানি সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় থাকতে হয় বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে। এই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা মেরামতে নেই কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই কোন আশার বাণী। প্রথমে খাবার ও জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য পানি সংগ্রহ করা হয়, তারপর কপালে জুটলে হয় গোসল, কাপড় চোপড় ধোয়া দায়ী কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পানির চিন্তা।

 

তাই সিটি কর্পোরেশন পানির দাবিতে বিভিন্ন সময় মিছিল, মিটিং, অবরোধ ও মানববন্ধনসহ বিভিন্ন উপায়ে প্রশাসনকে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা জানানোর জন্য চেষ্টা করলেও এখানে কর্তৃপক্ষ নির্বিকার ও উদাসীন ভূমিকা পালন করছে বলে স্থানীয়দের দাবি। সম্প্রতি সময়ও এই পানি সমস্যায় প্রকট আকার ধারণ করায় ভোগান্তিতে আছে বন্দরের বাসিন্দারা। এই তীব্র তাপদাহেও সেখানে দেখা দিয়েছে পানির জন্য হাহাকার।

 

বন্দরের নাসিকের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এবং বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বন্দর এলাকার ৯ টি ওয়ার্ডেই পানির সংকট আছে। সিটির মদনগঞ্জ থেকে মদনপুর পর্যন্ত অবস্থিত নয়টি ওয়ার্ডের সবগুলোতেই এই পানির সমস্যা। তবে ১৯নং ওয়ার্ড থেকে ২৫নং ওয়ার্ড এলাকা পর্যন্ত এই সংকটে তীব্র আকারে সাধারণ জনগণ। এখানে শুধু বিশুদ্ধ খাবারের পানিই নয়, সাধারণ ব্যবহারের পানিও পাওয়া যায় না।

 

স্থানীয়রা জানান, এই এলাকার মদনগঞ্জ ফরাজিকান্দা, দড়ি সোনাকান্দা, ঋষিপাড়া, বেপারী পাড়া, কোটপাড়া, বন্দর শাহী মসজিদ, বন্দর বাজার আমীন রুপালী, রাজবাড়ী, খানবাড়ির চিতাশাল মোড়, তালতলা, ইসম্পাহানি, কদম রসুল কলেজ, কবিলার মোড়, কামাল উদ্দিনের মোড়, নোয়াদ্দা, কাইতাখালী, আমিরাবাদ, বক্তারকান্দি, দেউলী চৌরাপাড়া, সোমবাড়িয়া বাজার, দক্ষিণ লক্ষণখোলা, উত্তর লক্ষণখোলা, দাসেরগাঁও, পাতাকাটা এলাকার হাজার হাজার লোকের পানির বেশিরভাগ ব্যবহারই এক সময শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপর নির্ভর করতো।

 

গোসল থেকে শুরু করে কাপড় চোপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ধোয়াসহ দৈনন্দিন কাজকর্মের সবই এই নদী কেন্দ্রীক ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় পানি পান করা কিংবা ব্যবহার কারাতো দূরের কথা পানির স্পর্শ নেওয়াই বিপদজনক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রায় দুই সপ্তাহ জুড়ে ২০, ২১ এবং ২২ নং ওয়ার্ডে এই সমস্যা আবারও প্রকট আকারে ধারণ করেছে। ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডে এই সমস্যা দীর্ঘদিন যাবত। সর্বশেষ গত প্রায় নয় মাস যাবত ২৪ নং ওয়ার্ডের এসিআই সংলগ্ন পানির পাম্পটি নষ্ট হয়ে আছে।

 

পাম্পটি মেরামতে অনেক টাকা খরচ হবে বলে নির্বিকার হয়ে বসে আছে নাসিক। পানির দাবিতে প্রায় সময়ই নাসিকের ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডের জনগণকে দেখা যায় হাড়ি, পাতিল, কলসি, জগ ও মগসহ বিভিন্ন পাত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে। এসব এলাকায় কাউন্সিলরদের উদ্যোগে কিছু কিছু গাড়ি দিয়ে পানি সরবরাহের চেষ্টা করা হলেও চাহিদার তুলনায় তার পরিমাণ খুবই কম।

 

গতকাল বিকেলে বন্দরের ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডে পানির দাবিতে মিছিল করে এলাকাবাসী। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচী দিয়েও কর্তৃপক্ষকে সজাগ করা যায়নি বলে দাবি করেন তারা। এ সময় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এলাকাবাসী বলেন, পানি সংগ্রহের জন্য আমাদের নানান জায়গায় যেতে হয়। বিভিন্ন মসজিদ, স্কুল কিংবা মিল কারখানায় যেতে হয় পানি সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু এভাবেতো আর প্রয়োজনীয় সব পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এত বছর যাবত আমরা পানি সমস্যায় ভূগলেও নাসিক সেদিকে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

 

অন্যদিকে, দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বিকল থাকার পরও ২৪ নং ওয়ার্ডের পানির পাম্পটি সংস্কার বা মেরামতের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় পানি সরবরাহের দাবিতে বুধবার বিকেলে চৌরাপাড়া এলাকায়  কলস নিয়ে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী। এ সময় শতাধিক নারী পুরুষ সড়ক অবরোধ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, জহিরুল ইসলাম শাওন, আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ শাকিল, মাজেদা আক্তার, মজিবুর রহমান, জাকির হোসেন প্রমুখ।

 

বক্তারা বলেন, দীর্ঘ দিনেও পাম্পটি সচল করার উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। এ অবস্থায় পাশের মসজিদ থেকে শুধু খাবার পানিটুকু সংগ্রহ করছেন মানুষ। বিশুদ্ধ পানির দাবিতে এরই মধ্যে আরও কয়েক বার বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করা হয়েছে । কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো র্কণপাতই করছে না। তারা আরও জানান, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে ২৪ নং ওয়ার্ডের চৌরাপাড়া পাম্পটি বিকল হয়ে আছে। মেরামত না করায় নয় মাস ধরে ওয়াসার লাইনে পানি পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। দূরের কোনো পাম্প হাউস থেকে মাঝে মাঝে লাইনে পানি আসে।

 

২৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা কবির সোহেল জানান, বিভিন্ন সময় হঠাৎ করেই কোন না কোন পাম্প বিকল হয়ে পড়ছে। ফলে সারা বছরই পানি সংকট লেগে আছে ওয়ার্ডগুলোতে। পানি সংকট নিরসনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ২০১৮ সালে ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডে ৩টি সহ বন্দরে ১৭টি সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই পাম্পগুলো বর্তমানে বিকল হয়ে আছে।

 

এ ব্যাপারে দেউলী চৌরাপাড়া পাম্প হাউসের অপারেটর আলামিন জানান, প্রায় ৯ মাস আগে  পাম্পটি নষ্ট হয়। বিষয়টি আমি তখনই লিখিতভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এরপর আরও কয়েকবার জানানো হয়েছে। ১০ দিন আগে সিটি করপোরেশন থেকে দুইজন লোক এসে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। এরপর আর কেউ আসেনি।

 

অন্যদিকে বন্দরের ২২ নং ওয়ার্ডের এইচএম সেন রোডের রাজবাড়ি পানির পাম্পটি নষ্ট হওয়ার দীর্ঘদিন পর মেরামত করা হলেও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না এলাকাবাসী। এতে করে এই তীব্র তাপদাহেও চরম দুর্দশায় আছে জনগণ। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ ২২ বছর পূর্বে এই পাম্পটি স্থাপন করা হয়। বুড়ো হয়ে যাওয়া পাম্পটি এখন অনেকটাই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। এখানেও গোসলের পানিতো দূরের কথা ওজু এবং পান করার জন্য পানি সংগ্রহ করাটাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে।

 

তবে এই সংযোগের সাথে সংযুক্ত থাকা নিচু স্থানগুলোতে যেখানে অবৈধভাবে একাধিক পানির সংযোগ করা আছে সেখানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পানি বের হয়ে অপচয় হচ্ছে। এই জন্য বন্দর কলোনী এলাকার মুখে একটি চেকভাল্ব বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি।

 

নাগরিক কমিটির বন্দর শাখার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হযরত আলী বলেন, এইচএম সড়কে বহতল ভবন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই পুরানো ও জীর্ণ ধরা পাম্প দিয়ে চাহিদা মিটানো সম্ভব হয় না।

 

পানির সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে নাসিক ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, এই বিষয়ে চেষ্টা চলছে। যে যে এলাকায় পানির সমস্যা আছে সেখানে আমরা গাড়ির মাধ্যমে পানি বিতরণ করে কিছু ব্যাকআপ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে তা পর্যাপ্ত পরিমাণ না। যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটি সমাধান করার জন্য আলাপ আলোচনা চলছে। গতকাল অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা আশা করতেছি হয়তো খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে।

 

নাসিকের প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নাসিকের ২৪ নং ওয়ার্ডের চৌরাপাড়ার পাম্পটি বিকল হয়ে গেছে। এখানে নতুন পাম্প স্থাপন করতে হবে, যা অনেক টাকার ব্যাপার। তাই এই পাম্পটি বসাতে এত বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর