বৃহস্পতিবার   ১২ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২৭ ১৪৩১

বাবার ঝুট বণ্টনের টোকেনে ছেলে নেন পার্সেন্টেজ!

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪  

 সরকার পরির্বতনের পর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার শাসনগাঁও বিসিকের শিল্প-কারখানাগুলো ঝুট সেক্টর, সুতার কোন, কার্টুনসহ বিভিন্ন ওয়েস্টেজ পণ্যের ব্যবসা যেগুলো আওয়ামী লীগের প্রভাবশীল পরিবার ওসমান ও তাদের দোসদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো সবই নিয়ন্ত্রণে হাত-বদল হতে দেখা গেছে। এদিকে ফ্যাসিস্ট ওসমান পরিবারের আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হাতেম ৫ আগষ্ট স্বৈরাশাসকের বিদায়ের পর অবস্থা বুঝে গত ২৫ আগষ্ট সেলিম ওসমানের প্রেসক্রিপশনে বিকেএমই‘এর নির্বাহী সভাপতি থেকে সভাপতি পদ দখল করেন। নির্বাচন ছাড়া ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিকেএমই’এর সভাপতি পদ দখল করে চাঁদাবাজিসহ সকল ধরনের স্বৈরাচারিতা করার অভিযোগ ছিলো সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে। সেই সেলিম ওসমানের অন্যতম সহায়ক হিসেবে মেহাম্মদ হাতেম ও ছায়াসঙ্গী হিসেবে ছিলেন। ফ্যাসিস্টদের বিদায়ের পর বিকেএমই‘এতে ওসমানদের ছায়া হিসেবে মোহাম্মদ হাতেম এখনো তাদের নির্দেশনা কাজ করছেন বলে অভিযোগ সর্বমহলে। এছাড়া স্বৈরাচারের দোসর এই হাতেম বিকেএমই‘এর সভাপতি হিসেবে বহাল থাকতে শিল্প অঞ্চল শাসনগাঁও বিসিক এলাকা জুড়ে করছেন নানা ষড়যন্ত্র। ওসমানদের প্রেসক্রিপশনে বিএনপির শত্রু করছে বিএনপিকেই। নেতাদের প্রভাব যাচাই বাছাই করে দিচ্ছেন বিভিন্ন নিট ওয়্যার গামেন্টর্সের ঝুট নিয়ন্ত্রণের টোকেন। এর থেকে বঞ্চিত হওয়া অনেকের মধ্যে ইতিমধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হতে দেখা গেছে। বর্তমানে বঞ্চিত অনেকেই ক্ষোভে রয়েছে যাকে ঘিরে রয়েছে সংঘর্ষের আশঙ্কা পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ও টোকেনের মাধ্যমে নানাভাবে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন এই মোহাম্মদ হাতেম। আর এটা তিনি প্রকাশ্যে না করলে ও তার ছেলে এ.বি নীট ফ্যাশন লিমিডেটের ডাইরেক্টর হাসিন আরমান (অয়ন) এর নামে নিচ্ছেন বড় বড় নীট ওয়্যার গার্মেন্টসের টোকেন প্রতি নিচ্ছেন মোটা অংকের পার্সেন্টেজ। এছাড়া ও বিভিন্ন গার্মেন্টস এর ঝুট ও ওয়েস্টিজ হাতেম ও তার ছেলে সেকেন্ড পার্টি হয়ে বেড় করার মতো নজির ও রয়েছে। 

 

এদিকে জানা গেছে, হাতেমের ছেলে পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে ভোলাইল এলাকার কনক গার্মেন্টস এর ঝুট, ওয়েস্টিজ মালামালের সাথে যা পুরোটিই প্রকাশ্যে। এ ছাড়া হাতেমের ছেলে অয়নের সাথে পট পরিবর্তনের পূর্বে রাজধানীর একটি নাইট ক্লাবে সুসম্পর্ক হয়ে উঠেছিলো ফতুল্লা থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব রাসেল মাহমুদের সাথে যাকে ঘিরে বাবা হাতেমের কাছ থেকে বিসিকের ছোট বড় প্রায় ২২টি নীট ওয়্যার ও নিটিংয়ের ঝুট ও ওয়েস্টিজের মালামাল নামানোর টোকেন দেওয়া হয়েছিলো। সেগুলো হলো, নীট গার্ডেন, লারিব-২, জেমসের গল্লির ২টি , তায়েবের গল্লির সকল, ওয়েনটেক্স, বিসিক ডার্চ বাংলা ব্যাংক গলি সবগুলো, রাজিয়া, ফ্্রীডমসহ আরো বেশি কয়েকটি। সেখান থেকে ও মোটা অংকের একটি পার্সেন্টেজ পেত হাতেমের ছেলে অয়ন। এছাড়া বিসিকের টোকেনযুক্ত গার্মেন্টস থেকে মাল নামলেই সেখান থেকে পার্সেন্টিজ নিতে চলে যান হাতেমের ছেলে অয়নের চ্যালাচামুন্ডারা। বিগত দিনে হাতেমের এই ছেলের সঙ্গে ভালো সখ্যতা ছিলো নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান ও ভাতিজা আজমেরী ওসমানের সাথে। হাতেমের ছেলে হিসেবে আর অয়ন ওসমানের মিতা হিসেবে ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতেন তাদের মাধ্যমে। হাতেমের ছেলে অয়ন ঢাকায় ও বেশির ভাগ সময় দিতেন অয়ন ওসমানের সঙ্গে জানিয়েছে সূত্র।  


সূত্র বলছে, বিসিক শাসনগাঁও এলাকায় বড়, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে প্রায় ৫০০ তৈরি নীট ওয়্যার ও নিটিং কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বড় রয়েছে ১০৮টি সবগুলোর ন্যায় বড়গুলো ও মোহাম্মদ হাতেমের টোকেনের দখলেই। তিনি যখন যাকে গার্মেন্টস থেকে মালামাল নামানোর টোকেন দিচ্ছেন তখনই বিএনপির কিছু নেতাকর্মীরা হাতেমের জয়জয়কার বলে তার কথায় সেগুলোতে মালামাল নামাচ্ছে বলে জানা গেছে। ঝুট ব্যবসায় মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঘুরেফিরে হাতেমের নামটিই চলে আসে বারবার। সরকার পতনের পরও গোটা ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসার প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেছেন হাতেম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জানান, বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসা করতে গেলে প্রথম অনুমোদন নিতে হয় হাতেমের। বিসিক এলাকায় ঝুট নিয়ে যেসকল অসন্তোষ শোনা যায় এরপেছনে হাতেমকেই দায়ী করেন তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে ওসমানদের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদ হাতেম। স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওসমানদের ছায়ামুক্ত হতে পারেনি বিকেএমই’এ। বর্তমানে এই হাতেম নিজের অবস্থান আগামী দিনে ও ওসমানদের সময়ের মতো ভালো অবস্থানে রাখতে ও এখানে বসে পালিয়ে যাওয়া ওসমানদের সুবিধা দিতে ঝুটের টোকেনের মাধ্যমে বিএনপি নেতাদের হাত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। আর একই সাথে পার্সেন্টিজের মাধ্যমে তার ছেলেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন। তা ছাড়া হাতেমের এই ছেলে অয়নকে তিনি সর্বদা তার সাথে রেখে বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত করছেন রাজধানীতে ও নারায়ণগঞ্জের বড় বড় গার্মেন্টস এর ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন দুই বাপ ছেলে। কিছু জায়গায় নিজেই হচ্ছেন প্রথম বা সেকেন্ড পার্টি কিছু জায়গায় সরাসারি করতেন ছেলেকে। এদিকে দীর্ঘবছর মাফিয়া কায়দায় ব্যবসায়ী সংগঠনটিকে ধ্বংস করে বর্তমানে নিজেই নিজের অবস্থান নিয়ে শক্ত অবস্থায় রয়েছেন। ৫ আগস্টের পর হাতেমের বড় ছেলে অয়নকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সাইবার যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করার প্রয়াস চালান হাতেম। অথচ শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের সাথে ঢাকায় বেশিরভাগ সময়েই হাতেমের ছেলে অয়নের সখ্যতা ছিল। এছাড়া  আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হাতেমের ছেলে অয়ন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি, ঢাকা সিটি মেয়র আতিকসহ আওয়ামীলীগের ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে কথায় কথায় সেল্ফি তুলতেন। অথচ সেই হাতেমের ছেলেকেই এখন তিনি সাইবার যোদ্ধা বলে চালিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করেছেন। সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর বিকেএমই’র ইজিএম অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অবদান রাখা ৪০ ব্যবসায়ীর সাথে হাতেমের ছেলেকেও স্টেজে তোলা হয়। এনিয়ে বিস্মিত ও হতবাক ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চেয়ার দখল করতে হাতেমের প্রচেষ্টার প্রশংসা করতেই হয়। ওসমানদের ঘনিষ্ঠ এই দোসর ৫ আগস্টের পর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন নিজের অতীতের খোলস বদলাতে। যদিও হাতেম  ও বিকেএমইএ’র বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন সরকারের  বাণিজ্য উপদেষ্টা, ও সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন বৈষম্যর শিকার বিকেএমইএ এর সাধারণ ব্যবসায়ীরা।


অভিযোগপত্রে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) দেশের নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকদের একটি জাতীয় বাণিজ্য সংস্থা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্বেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দরা তাদের কার্যকলাপের জন্য সবসময়েই ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১০ সাল থেকে টানা ১৪ বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। প্রথমবার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নামকাওয়াস্তে কয়েকটি নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে তথাকথিত সমঝোতা'র মাধ্যমে পর্ষদ করে নিজের অনুগতদের নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করেছেন। বিকেএমএই তে সব কিছুই চলতো সেলিম ওসমানের নির্দেশনা অনুযায়ী। এমনকি কে কোন পদে থাকবেন সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর গত ২৪ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ থেকে সেলিম ওসমান পদত্যাগ করেন। তবে তিনি কমিটি পুনর্গঠন করার ঘোষণা না দিয়ে নতুন সভাপতি নির্বাচন করেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পর্ষদকে অনুরোধ করেন যা এই ধরনের নেতৃস্থানীয় সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেলিম ওসমান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, 'বর্তমান নির্বাহী সভাপতি হাতেম দীর্ঘদিন ধরে আমাকে, বিকেএমইকে ও নিট সেক্টরের উন্নতির জন্য সহায়তা করে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি পরিচালনা পর্ষদের সকলের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, আমার বিদায়ের পর পর বিকেএমইএ ও নিট সেক্টরের উন্নয়নকল্পে মোহাম্মদ হাতেম এর অবদান এবং প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে তাকে এই নতুন বিকেএমইএ পরিচালনার জন্য সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হোক (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) অনুগত পর্ষদও বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা মেনে নিয়েছেন এবং মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি, সাবেক স্বৈর-শাসকের দোসর সেলিম ওসমানের অনুগতদের নিয়েই গঠিত হয়েছে প্রহসনের বর্তমান পর্ষদ।


উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হাতেম বিগত তিন বছর যাবত নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে ২০২১ সালে নির্বাহী সভাপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে বসান সেলিম ওসমান। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটাই সেলিম ওসমানের অনুগত থেকে মোহাম্মদ হাতেমও পুরোপুরি ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করেছেন। তিনি সরকারের কতটা আজ্ঞাবহ সর্বশেষ তার প্রমাণ দিয়েছেন গত ২২ জুলাই।


সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।

এই বিভাগের আরো খবর