বুধবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৪ ১৪৩১

বিসিকে হাতেম গ্রুপের লঙ্কাকাণ্ড

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪  

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে কিছুদিন যাবৎ দফায় দফায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাকে ঘিরে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় হামলা ও ভাংচুরের মতো তুচ্ছ ঘটনা ঘটছে। যা নিয়ে কোন প্রকারের মাথা ব্যাথা নেই বিকেএইম‘এ এর সভাপতি ও বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের। সব কিছুই সাইডে রেখে তিনি বর্তমানে তার ঝুট ব্যবসা ও বিসিক এলাকায় ঝুট বণ্টন ও সেখান থেকে কমিশন তা ছাড়া গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরী থেকে মাসিক মাসোয়ারা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে গত কয়েকদিন যাবৎ ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে ভোলাইল এলাকায় অবস্থিত এন আর গ্রুপে।  যার পরিচালক মোখলেছুর রহমান। যিনি আওয়ামী লীগের ওসমানদের দোসর  বিকেএমই‘এ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া মালিক মোখলেছুর দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের বাহিরে অবস্থান করায় এন আর গ্রুপ পরিচালনা করে যাচ্ছেন   মোহাম্মদ হাতেম। এ দিকে গতকাল রবিবার বিকেলে বিসিকের ২ নম্বর গেটে শ্রমিক অসন্তোষে একাধিক পোশাক কারখানায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কারখানাগুলোর জানালার কাচ, সিসি ক্যামেরা এবং গেট ভাঙচুর চালায়।


প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন যাবৎই শ্রমিক অসন্তোষ কারণে এনআর গ্রুপের সকল কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে আজকে শ্রমিকরা হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে বিসিক এলাকায় আসলেই লারিভ নীট ওয়্যারের উপর থেকে হাতেমের পালিত কিছু বাহিনী শ্রমিকদের উপরে ইটপাটকেল ছুঁড়লে সেখানে বহু শ্রমিক আহত হয়। হঠাৎ শ্রমিকরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ভাংচুর ও হামলা চালায়। এতে ফকির ও লারিভ গ্রুপ, আর এস গার্মেন্টস, প্যানটেক্স লিমিটেড, জীবন নীট ওয়ার, ইউনাইটেড গার্মেন্টসে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় আশেপাশে থাকা হাতেমের চ্যালাচামুন্ডা ও হাতেমের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া এনায়েতনগরের কিছূ ছাত্রদল, যুবদলের লোকজন একত্রিত হয়ে হয়ে অসন্তোষ শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে এক দফা ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে এতে অনেক শ্রমিক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের পরিচয় বা সংখ্যা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।


নাম প্রকাশে অন্চ্ছিুক একজন শ্রমিক জানান, গত (১০ ডিসেম্বর) মঙ্গলবার এন আর গার্মেন্টস এর ইমপ্রভমেন্টু ও অপারেটরের সাথে কথা কাটাকাটি হয় এক পর্যায়ে ইমপ্রভমেন্ট সেই অপারেটরকে ধাক্কা দেয়। এক পর্যায়ের সেই অপারেটর উত্তেজিত হয়ে গেলে সেখানে থাকা ফ্লোরের ইনচার্জ ও পিএম সেই ইমপ্রভমেন্টের সাথে একত্রিত হয়ে সেই অপারেটর শ্রমিককে মারধর করে আর বলে যে, তোরা কি জানোস না এটার দায়িত্ব আছে কে বিকেএমই‘এ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সাহেব, এটার তার ভাইয়ের গার্মেন্টস। তাকে একটা ফোন দিলে তার পালিত বাহিনী নিয়ে এসে এখানকার ফ্লোরের সকল অপারেটরদের পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া যাবে। যাকে ঘিরে পরবর্তীতে তা শুনে সেই উত্তেজিত ফ্লোরের অপারেটর সব এক সাথে হয়ে সেই ইমপ্রুভমেন্ট, ফ্লোরের ইনচার্জ ও পিএমকে মারতে মারতে ফ্লোর থেকে বেড় করে দেয়। পরে তারা বেড় হয়ে এন আর গ্রুপের বাকি ৪টি ফ্যাক্টরীতে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে সকল অপারেটরদের বেড় করা হয়। পরে দীর্ঘক্ষণ রাস্তা অবরোধ রেখে গেইটে ইটপাটকেল ছুঁড়ে এনআর গার্মেন্টস এর সকল কার্যক্রম বন্ধ করে তারা বাসায় চলে যায়। পরবর্তীতে গত (১১ ডিসেম্বর) বুধবার শ্রমিক পক্ষ থেকে মালিক পক্ষকে ১৭টি দাবী দেওয়া হয়। (১২ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার এনায়েতনগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলমগীর হোসেন, বিকেএমই‘এ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, সেখানকার যুবদল, ছাত্রদল নেতাকর্মীরাসহ নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার আরো বেশ কয়েকজন এন আর গার্মেন্টসে বসে শালিশের মাধ্যমে শ্রমিকদের সকল দাবী মেনে নেয়। এর মধ্যে প্রোডাকশন কমিয়ে দিতে হবে যেমন প্লো শার্ট এর টার্গেট রয়েছে ১৩০ পিএস তা কমিয়ে টার্গেট করতে হবে ৮০ পিস  আর টি-শার্ট এর টার্গেট রয়েছে ৩০০ পিএস সেটা দিতে হবে সিঙ্গেল লাউয়ারে ২০০ পিএস , তা ছাড়া আই ডির্পারমেন্ট থাকতে পারবে না, আরেকটি রয়েছে যে কিছু চিহ্নিত ইমপ্রভমেন্ট, ইনচার্জ, পিএমকে চাকুরিচুত্য করতে হবে এই ৩টি দাবী না মানায় অপারেটর কেউ কাজে বসেনি। তারা বিকাল ৫ টায় এন আর থেকে বেড়িয়ে বিসিক যায় এক পর্যায়ের শ্রমিক অসন্তোষ লক্ষ্য করে সেখানে থাকা একটি গ্রুপ ২ নাম্বার গেইটের লারিব গার্মেন্টস এর উপরে উঠে পরে আর সেখান থেকে বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের উপরে হামলা চালানো শুরু করেন। যাকে ঘিরে অনেকেই আহত হন পরবর্তীতে সকল শ্রমিক রাগে-ক্ষোভে বিভিন্ন গার্মেন্টসে হামলা চালায়। তখন সেখানে থাকা কয়েকটি গ্রুপের গুন্ডা বাহিনী লাঠিসোঠা নিয়ে শ্রমিকদের উপরে হামলা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এর একটু পরেই সেখানে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি ঠান্ডা করেন।


এ বিষয়ে শিল্প পুলিশের পরিদর্শক সেলিম বাদশা জানান, এনআর গ্রুপের শ্রমিকরা ১৭ দফা দাবিতে আন্দোলন করছিল। তাদের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়া হলেও একটি ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটেছে, যা অপ্রত্যাশিত।


ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরিফুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে পুলিশ বিসিক এলাকায় অভিযান চালাবে।


নিটিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম সারওয়ার দাবি করেন, “বিসিক এলাকায় কিছু বহিরাগত ও কয়েকজন শ্রমিক একসঙ্গে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ ও কারখানার অন্যান্য শ্রমিকদের সহায়তায় হামলাকারীদের প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।”


এর আগে, গত (১১ ডিসেম্বর) বুধবার দুপুর থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার শাসনগাও এলাকায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরীতে বিকেএমই‘এ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট র্মোশেদ সারোয়ার সোহেলের মালিকানাধীন আরএস গার্মেন্টসের শ্রমিকরা পঞ্চবটি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে।  সেই শ্রমিকদের দাবী ছিলো ৫% থেকে বাড়িয়ে ৯% হাজিরা বোনাস ও নাইট বিল দিতে হবে। এ দাবী মেনে নিয়ে মালিককে কারখানা থেকে নেমে সড়কে এসে ঘোষনা দিতে হবে। নয়তো সেনাবাহিনী এসে সমাধান করে দিতে হবে। এ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন লক্ষ্য করা গেছে।


এ দিকে এন আর গ্রুপের মালিক হাতেমের আত্মীয় হওয়ায় আর অনাকাক্ষিত কারণে এই গ্রুপের দায়িত্ব তা কাছে থাকায় এই গার্মেন্টস এর ঝুট নিয়ন্ত্রণ তিনি একাই করতেন। এ ছাড়া সেই এলাকার আশপাশের নেতাকর্মীরা ঝুট চালাইলেই কাউকে ঝুট না দিয়ে মাসিক বেতনভুক্ত করে রেখেছিলেন এই হাতেম। আর এখানকার ঝুট ও ওয়েস্টিজসহ সকল কিছুর ফাস্ট পার্টি- সেকেন্ড পার্টি দুটোই মোহাম্মদ হাতেম নিজেই। আর এই এন আর গ্রুপের সুবাদে তা ছাড়া ওসমানদের দোসর হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ভোলাইল এলাকার শহরআলী মাদবরের ছেলে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাসানকে দিয়ে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট সহ বিভিন্ন অপকর্ম করাতেন সাইফুল্লাহ বাদল ও ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম। সন্ত্রাসী হাসান বিগত সরকার আমলে সাইফুল্লাহ বাদল ও আজমেরী ওসমানের ক্যাডার হিসেবে ভোলাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো।

 কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পদত্যাগের পর থেকে সেই সন্ত্রাসী হাসান এখন নব্য-বিএনপির সেজে আবারও ভোলাইল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। যেটির মূল পরিকল্পনাকারীও এই ওসমানদের দোসর হাতেম। জানা যায়, সন্ত্রাসী হাসান জমির দালাল ও মুদি দোকানদার ছিলেন। বিগত সরকারের আমলে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ বাদল, বিকেএমইএ'র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, কাশিপুর ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার শামীম আহমেদ, কাশিপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেক লীগের সভাপতি আল-আমিন ও সাইফুল্লাহ বাদলের বোন জামাতা সানাউল্লাহসহ আরও কয়েকজন মিলে হাসানের সহযোগিতায় ভোলাইল ‘মরা খাল' (ভোলাইল মিষ্টির দোকানের পেছনে) ১৭০নং কাশিপুর মৌজার ১নং সিট এর সরকারি জায়গাটি দখল করে এন-আর গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। জানা যায়, এন-আর গ্রুপের কাছে সরকারি খালে জায়গাটি হাসানের মাধ্যমে তিন কোটি টাকা বিক্রি করা হয়। সেই সময় এন-আর গ্রুপ সরকারি খালের জন্য দেড় কোটি টাকা হাসানের মাধ্যমে লেনদেন করেন এবং পরে জায়গার কাগজ পত্র হলে আরও দেড় কোটি টাকা দিবে বলেন জানান।

 এদিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তর নরসিংপুর মরা খালপাড় এখন সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালের চারপাশে দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়েছে এন-আর গ্রুপ। মূলত এই গোটা দখলে নেতৃত্ব দিয়েছে ওসমানদের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম। এছাড়া কাশীপুরের চর নরসিংপুর এলাকম শতকে শতকে জমি তার ম্যানেজার হাসানের মাধ্যমসহ আরো কয়েকটি সিন্ডিকেটের করে জিম্মি করে রেখেছেন। যা নিয়ে হাতেমের বিরুদ্ধে শীগ্রই হতে পারে মানববন্ধন। ইতিমধ্যে হাতেমের অপকর্মের বিরুদ্ধে সজাগ হতে শুরু করেছে ব্যবসায়ীসহ জমি হারা অসহায় অনেকেই। বর্তমানে তাকে ওসমানদের দোসর বানিয়ে তার বিরুদ্ধে বাণিজ্যো উপদেষ্টা ও সচিব বরাবর অভিযোগপত্র দাখিল করেছে নারায়ণগঞ্জের দুইজন ব্যবসায়ী।
 

এই বিভাগের আরো খবর