মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

মায়ের খোঁজে মেয়ে, মেয়ের খোঁজে বাবা

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২১  

মা মিনা আক্তার আর মেয়ে চম্পা আক্তার দুজনেই কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড লিমিটেডের সেই কারখানায়। মেয়ে চম্পা ছিলেন দোতালায় আর মা মিনা আক্তার চতুর্থ তলায়। আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে মেয়ে চম্পা একটি কাজে কারখানা থেকে বের হয়েছিলেন। এরপরই সূত্রপাত ভয়াবহ সেই অগ্নিকান্ডের। পরে বাইরে থেকে মায়ের জন্য আহাজারি করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না চম্পার।

 

বৃহস্পতিবার পুরো রাত ছিলেন কারখানার সামনেই। শুক্রবার বিকালে এসেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে, মাকে খুঁজতে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে চম্পা বলছিলেন, ‘সকালে মায়ের সঙ্গে একলগে কারখানায় গেছি। মায় সকালে উইঠা ভাত রানছে। দুইজনে খাইয়া বাসা থেকে বের হইছি। ৯টায় কারখানায় গিয়া আমি দোতালায় ঢুকছি, মা গেছে চার তলায়। রাত ৯টায় কারখানা ছুটি হওয়ার কথা। একসঙ্গেই বাসায় যাইতাম। কিন্তু এর মধ্যেই ঘইটা গেলো আগুনের এই ঘটনা।’ ‘অন্য দিন দুপুরে দেখা হইতো। কাইলকা দুপুরে দেখাও হয় নাই। আগুন লাগার একটু আগে আমি বাইর হইছিলাম বইলা বাঁইচ্যা গেছি। মা তো বাইর হয় নাই’ বলেই কেঁদে উঠলেন তিনি। স্বজনরা তাকে ধরে রেখেছেন। সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু একসঙ্গে কাজে গিয়ে মাকে হারানো মেয়েকে কী বলে সান্তনা দেবেন, সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

 

শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে স্বজনদের এমন আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কারো হাতে প্রিন্ট করা ছবি, কেউ ঘুরছেন পরিচয়পত্র নিয়ে, কেউবা মোবাইলে ছবি দেখিয়ে খুঁজছেন স্বজনদের। সবার চোখই অশ্রুসিক্ত। স্বজনদের খুঁজে না পেলেও সবারই ধারণা নিখোঁজদের কেউ আর বেঁচে নেই। এখন মরদেহ শনাক্ত করে গ্রামে নিয়ে দাফন করাটাই তাদের চাওয়া।

 

বৃহস্পতিবার (৮ জুন) বিকাল সাড়ে পাঁচটায় সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস লিমিটের ছয় তলা একটি কারখানায় হঠাৎ আগুন লাগে। প্রায় ২৪ ঘন্টার চেষ্টায় শুক্রবার (৯ জুন) বিকালে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিচতলা, দোতালা, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় ৪৮টি মৃতদেহ। আগুনে পুড়ে ছাড়খার হওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করতে উদ্ধার করা সেসব মৃতদেহ আনা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।

 

রাতভর কারখানার সামনে অপেক্ষারত স্বজনরা মৃতদেহ ঢামেক হাসপাতালের মর্গে নেওয়ার খবর পেয়ে ছুটে আসে এখানে। কিন্তু ডিএনএ নমুনা ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ডিএনএ ফরেনসি ল্যাবের কর্মীরা। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে তারা স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছেন। মায়ের খোঁজে চম্পার সঙ্গে ঢামেক মর্গে আসা দেলোয়ার জানান, তারা চার ভাই দুই বোন। ভাইয়েরা সবাই বিভিন্ন কাজ করেন। বাবা মঞ্জিল ভূঁইয়া কারখানার পাশেই গাউছিয়া এলাকায় চায়ের দোকান করেছেন। দেলোয়ার বলেন, ‘মায়েরে তো আর জীবন্ত পাওয়া যাইবো না। লাশটা দ্রুত শনাক্ত কইরা দিলেও আমরা কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে নিয়া দাফন করতে পারি। এইটা এখন আমাদের একমাত্র চাওয়া।

 

১৪ বছরের মেয়ে ফাতেমার একটা প্রিন্ট করা ছবি হাতে নিয়ে পাগলের মতো ঘুরছেন বাবা সুজন মিয়া। চেহেরা দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতরাতে একফোটা ঘুম হয়নি তার। কাছে গিয়ে জানতে চাইলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন তিনি। জানালেন, মেয়েটা বছর তিনেক ধরে ওই কারখানায় কাজ করতো। অভাবের সংসার। নিজে রিকশা চালান। কিন্তু একার আয়ে পাঁচ ছেলেমেয়ে আর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনের ভরণ-পোষণ তো চলে না। তাই মেয়েকে কাজে দিয়েছিলেন। মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

 

সুজন মিয়া জানান, তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে। রূপগঞ্জে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন। কারখানায় আগুন লাগার খবর শুনে দ্রæত সেই কারখানায় ছুটে যান। কিন্তু অনেক খুঁজেও মেয়েকে পাননি। ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে লাশ আনা হয়েছে শুনে ছুটে এসেছেন এখানে। কিন্তু শনাক্ত করতে পারেননি মেয়েকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুজন মিয়া বলেন, ‘কী করমুরে ভাই, অভাবের সংসার তাই মেয়েরে কারখানায় কাজে দিছিলাম। সেই কারখানা যে আমার মেয়েরে এমন কইরা কাইড়া নিবো, তা কি আর জানতাম। জানলে কি আর মেয়েরে এইখানে কাজে দিতাম। আহারে আমার মাইয়াডা না জানি আগুনে কত কষ্ট পাইয়া মারা গেছে।’

 

১৩ বছরের হাসনাইনের খোঁজে এসেছেন খালা লাইজু আর মামী ফরিদা। তারা জানান, তাদের ভাগিনার বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন থানার আমিনাবাদে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। তাই হাসনাইনের মা নাজমা বেগম বোনকে অনুরোধ করেন হাসনাইনকে কাজে দিতে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আড্ডাবাজি করে নষ্ট পথে যাচ্ছিল হাসনাইন। এ কারণে খালা লাইজু তাকে রূপগঞ্জে এনে হাসেম ফুড লিমিটেডে কাজে  দেন। থাকতো কারখানারই একটি মেসে। চতুর্থ তলায় কাজ করতো। আগুনের ঘটনার পর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না হাসনাইনকে। তাদের ধারণা, আগুনে পুড়ে হয়তো মারা গেছে। মাহফুজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি খুঁজছিলেন তার ভাগিনা সাজ্জাদ হোসেন সজীবকে।

 

তিনি জানান, আগুন লাগা ওই কারখানায় তার ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম ও ভাগিনা সজীব কাজ করতো। আগুন লাগার পর তার ভাই জানালা ভেঙে বের হতে পারলেও ভাগিনা সজীব বের হতে পারেনি। ভাগিনাকে খুঁজতে এসেছেন তিনি। এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সদস্যরা মৃতদেহগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা শুরু করেছে। সুরতহাল শেষে লাশের ময়নাতদন্তও করছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। ময়নাতদন্তের সময়েই মৃতদেহগুলোর ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হবে। স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া সিআইডির ডিএনএ নমুনা ও মৃতদেহের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে পরিচয় শনাক্তের পর লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা।

 

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রায় ২৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় ডাম্পিং (কোনও ডেডবডি আছে কি না) করছেন। ইতোমধ্যে পঞ্চম তলায় ডাম্পিং শেষ হয়েছে, তবে কোনও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
 

এই বিভাগের আরো খবর