বুধবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৪ ১৪৩১

মে মাসে না’গঞ্জের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ !

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২০  

ইমতিয়াজ আহমেদ : করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আশা জাগানিয়া কোন খবর নেই। দিনে দিনে পরিস্থিতি যাচ্ছে খারাপের দিকে। আইডিসিআর এর তথ্যমতে একদিনেই নারায়ণগঞ্জে ১৫০ জন আক্রান্ত হয়েছে।  জেলায় মোট করোনা রোগীর সংখ্যা গতকাল ছিল ৮৪৯ জন। 

 

প্রতিদিন সকালে নারায়ণগঞ্জ  জেনারেল  হাসপাতালে ৩/৪ টি লাশ আসে। এই মৃতদেহের কোনটিকে সন্ধিগ্ন মনে হলে ডাক্তাররা স্বজনদের সতর্ক করে দেন। আপাতত মৃতদেহ পরীক্ষা করা হয়না। মৃতদেহ নিয়ে আসা স্বজনদের অবগত করা হয়। 

 

করোনা চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীগণ। বেশি আক্রান্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্স। এই হাসপাতালের মোট ৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জন ডাক্তার ও ৮ জন নার্স ছিলেন। 

 

এছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতাল মিলিয়ে ২ জন ডাক্তারসহ ১৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী। সীমিত আকারে পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার একদিনের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তের গড় হার দ্বিগুন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। 

 

নারায়ণগঞ্জ জেলায় কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, লকডাউন অনেকাংশে শিথিল করা হয়েছে। খুলে দেয়া হয়েছে পোশাক কারখানা। হাট-বাজারে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছেনা। পবিত্র রমজান মাসে লোকজন ধর্মীয় ভাব আবেগের বশে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে ভুলতে বসেছে। 

 

হাটে-বাজারে যার প্রমাণ মিলে। করোনার আগের চেয়েও এখন বাজারে মানুষের ভিড় বেশি। অনেক মহল্লাতেই মসজিদে তারাবীর জামাত হচ্ছে। এলাকাবাসী লকডাউনকে ধরে নিয়েছেন সরকারি নিয়ম। জীবন রক্ষার কবচ হিসেবে গণ্য করছেন না। 

 

এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা অনুসারে মে মাসে করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিবে। তবে পরিস্থিতি যত ভয়াবহ হোকনা কেনো-তা মোকাবেলায় প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। 

 

নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ ও নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার ডাঃ মো: সামসুদ্দোহা সঞ্জয় যুগের চিন্তাকে জানান, পরিস্থিতি যেমন হোক আমরা সেবা দিতে সর্বদা প্রস্তুত আছি। চলমান পরিস্তিতি মোকাবেলায় সরকার যেমন সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ দিবে আমরা সে মোতাবেক কাজ করে যাব। আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো ইনশা আল্লাহ। 

 

জানাগেছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নারায়ণগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগ  জেলার হাসপাতালগুলিতে বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। শহরের প্রধান দু’টি হাসপাতালের একটিকে করোনা হাসপাতাল ঘোষনা দেয়া হয়েছে। অন্যটিতে নিয়মিত চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। খানপুরে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে এখন শুধুই করোনা চিকিৎসা দেয়া হয়। 

 

নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চলছে নিয়মিত চিকিৎসা কার্যক্রম। এ ছাড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলছে করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজ। শহরের গ্রীণল্যাজ ব্যাংকের মোড়ে অবস্থিত নতুন কোর্ট ভবনে অবস্থিত  কোয়ারেন্টাইন সেন্টারটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। 

 

করেনার প্রথম অবস্থায় কোয়ারেন্টাইনের কাজ ছিল। এখন চলছে আইসোলেশনের কাজ। তাই জেলাজুড়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। খানপুর হাসপাতালটি করোনা হাসপাতাল হিসেবে কাজ করছে। এখানে ২৪ ঘন্টা জরুরী বিভাগে করোনা রোগীকে সেবা দেয়া হচ্ছে। 

 

জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ যুগের চিন্তাকে বলেন, করেনা মোকাবেলায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমরা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি। দুইটি সুখবর দেই। 

 

নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে এক সপ্তাহের মধ্যে  ভেন্টিলেটর সহ ১০ টি আইসিইউ বেড ও পিসিআর ল্যাব চালু করা হবে। আজ রূপগঞ্জে আমাদের মাননীয় বস্ত্রমন্ত্রী মহোদয় একটি ল্যাব চালু করবেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন করোনার স্যাম্পল কালেকশন করছেন। গতকাল ১৬০ টি স্যাম্পল কালেকশন করা হয়েছে।

 

এ যাবত মোট স্যাম্পল কালেকশন করা হয়েছে ২৫৮০ টি।  জেলায় করোনা চিকিৎসায় বিভিন্ন হাসপাতালে ১০০ আইসোলেশন বেড রাখা হয়েছে। এরমধ্যে খানপুর হাসপাতালে ৪০টি বেড, সাজেদা হাসপাতালে ৪০ বেড ও উপজেলার হাসপাতাল গুলিতে ২০ বেড। ইতিমধ্যেই ৮০ জন করেনা রোগী ভর্তি আছেন। 

 

করেনা পরিস্থিতি নিয়ে আশা জাগানিয়া কথা বললেন নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপারেনটেনডেন্ট ডাঃ মো: সামসুদ্দোহা সঞ্জয়। তিনি বলেন, যে কোন পরিস্থিতিতে আমরা করেনা রোগীদের সেবা দিতে প্রস্তুত আছি। নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালটি এখন পূর্ণাঙ্গ করেনা হাসপাতাল। ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। 

 

এখন ৪৯ জন করেনা রোগী ভর্তি আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে ১০ টি আইসিইউ বেড ( ভেন্টিলেটর সহ )। গত ১৩ এপ্রিল থেকে এখানে করোনা চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ২৪ ঘন্টা ইমার্জেন্সি বিভাগ চালু আছে করোনা রোগীর সেবায়। হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্যাম্পল কালেকশন করা হচ্ছে। স্যাম্পল কালেকশন কার্যক্রম চলছে ১০ দিন ধরে। 

 

প্রতিদিন ৩০টি স্যাম্পল কালেকশন হয়। গতকাল  সোমবার ৪০টি স্যাম্পল কালেকশন করা হয়েছে। আমার এখানে ৬ জন ডাক্তার ও ৮ জন নার্সসহ ৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী করেনায় আক্রান্ত হয়েছে। সামনে যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমরা তৈরী। প্রয়োজনে ফ্লোরে রেখেও আমরা করোনা রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিব। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। 

 

এদিকে, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় সেখানকার সার্জারী কনসালট্যান্ট ডাঃ মোঃ নাজমুল হোসেন এর সাথে। তিনি জানান,  জেনারেল হাসপাতালে এখন করোনা ব্যতীত সব রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। রোগীর চাপটা এখন কম। করোনার ভয় ও লকডাউনের কারণে মানুষ খুব একটা হাসপাতাল মুখি হতে চাননা। 

 

তবুও এখানে করোনার উপসর্গ নিয়ে কেহ এলে আমরা তাকে খানপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। প্রতিদিন সকালে ৪/৫ টি মৃতদেহ আসে। কোন উপসর্গ দেখলে বা সন্ধিগ্ন মনে হলে লাশের সাথে আসা স্বজনকে সতর্ক করে দেই। 

 

আমাদের ৬ জন স্টাফ করেনায় আক্রান্ত হয়েছে।  রোববার করোনা ধরা পড়লো আউটডোরের ডাক্তার জহিরুল ইসলামের। এরপর তাকে তার স্ত্রীসহ  কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। ডাঃ জহিরুলের স্ত্রীও ডাক্তার। আপাতত দু’জন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে চলে গেল। 

 

এদিকে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে আলাপকালে তাঁরা জানান, অন্তত আগামী দুই সপ্তাহ স্ট্রিক্টলি লকডাউন রাখা উচিৎ ছিল। শিথিল করা ঠিক হয়নি। সরকারের শিথিলতায় সাধারণ মানুষ এতোটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে তারা করোনার কথাই ভুলে গেছে। হাটে-বাজারে রাস্তাঘাটে সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই  নেই। 

 

সীমিত আকারে পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার একদিন পরেই নারায়ণগঞ্জে দৈনিক করোনায় আক্রান্ত  রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে। আইডিসিআর এর তথ্যমতে, গত ২৪ ঘন্টায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৫০ জন রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে।  মে মাসে আরো খারাপের দিকেই যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

 

অতএব লকডাউন শিথিল করার বিষয়টি পূণরায় বিবেচনা না করলে মহামারী শুরু হবে।  সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কেননা ইতিমধ্যে করোনার থাবায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। 

 

সবার আগে সিভিল সার্জন নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সকলের দোয়ায় তিনি এখন সুস্থ। নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। মহামারী ভয়াবহ রূপ নিলে লাশের মিছিল বাড়বে। মানুষ সচেতন না হলে হাসপাতাল ও ডাক্তার কাজে আসবেনা।  
 

এই বিভাগের আরো খবর