শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৭ ১৪৩১

যুদ্ধে যাওয়ারপথে কোলথেকে পড়ে শিশুপুত্র নিহত হওয়ার কষ্ট এখনোভুলিনি

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তার

প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তারের  লেখা মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তার : আমার জীবনের সৌভাগ্য যে, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দেশের সকল মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি তার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। আরো একটি কারণে আমি নিজেকেই সৌভাগ্যবান মনে করি, তা হলো আমার পরিবারের আমার ১১ জন ভাই-বোন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তারা সবাই আমার মতই যুদ্ধে অবদান রেখেছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে আমার এই গৌরবময় অবদানের পাশাপাশি একটি করূন এবং দু:জনক ঘটনাও ঘটেছে। তা হল আগরতলা যাওয়ার সময় আমি আমার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর গুলিবর্ষণের মুখে পড়েছিলাম। তখন পালাতে গিয়ে আমার শিশু পুত্র পলাশ আমার কোল থেকে ধান ক্ষেতে পড়ে গিয়ে আহত হয়। পরে আগরতলায় গিয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর সে মৃত্যুবরণ করে। সেই কষ্ট আমি এখনো বুকে বহন করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে করতে পেরেছি এই সাফল্যের কারনে আমি সেই শিশু পুত্র হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে চাই।

 

আমি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম। নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলাম। ১৯৬৮ সালে মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হই এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি নারায়ণগঞ্জ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এমনকি নারায়ণগঞ্জ শহরে খোলা জিপি চড়ে মাইক খাতে বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছি আমি। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রানিত হই।

 

কলেজে পড়ার সময় ১৯৬৭ সালে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খাঁজা মহিউদ্দিনের সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণায় আরো বেশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য দেশের মানুষকে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমার স্বামী খাজা মহিউদ্দিন আমাদেরকে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আগরতলা চলে যান।

 

তিনি না থাকায় আমরা অনেকটা অসহায় অবস্থায় পড়ে যাই। এক পর্যায়ে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেই, যে করেই হোক আমি আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আমার কয়েকজন আত্মীয় এবং আমার শিশু কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে ৭১ সালের ২৩শে মে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। তখন আমার একমাত্র কন্যা পাপড়ির বয়স ছিল তিন বছর এবং একমাত্র ছেলে তারিক ইমরান পলাশের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ মাস। তাদের নিয়েই আমি আগরতলা রওনা হই। নারায়ণগঞ্জ থেকে বৈদ্দের বাজার হয়ে লঞ্চে আমরা রামচন্দ্রপুর বাজারে পৌঁছি। সেখান থেকে আবার নৌকায় এবং পায়ে হেঁটে কসবা সীমান্তে পৌঁছে।

 

কসবা বর্ডার দিয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করার আগেই আমরা পাকিস্তান বাহিনীর প্রচন্ড গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে যাই। পাকিস্তান বাহিনীর গুলিবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা দৌড়ে বর্ডার থেকে পালিয়ে আবার বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে পড়ি। এ সময় আমার এবং আমার কোলে থাকা ছেলে পলাশের মাথার পাশ দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের গুলি চলে যায়। এতে আমরা এতটা ভীত হয়ে পড়ি যে কিভাবে দৌড়ে আত্মরক্ষা করব তার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। এই দৌড়াদৌড়ির সময় হঠাৎ আমার কোল থেকে আমার শিশু পুত্র পলাশ ধান ক্ষেতের পানিতে পড়ে যায়। প্রচন্ড আঘাত পায় সে এবং গুরুতর আহত হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে। আমি তাকে কোনো রকমে কোলে তুলে নিয়ে আবার দৌড়ে বাংলাদেশের ভিতরে অন্যদিকে পালিয়ে যাই।

 

পরে আমরা হবিগঞ্জের মাধবপুর হয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করি। সেখান থেকে আগরতলা গিয়ে আমরা প্রথমে উঠি কলেজ টিলা হোস্টেলে। সেখানে আগে থেকেই আমার স্বামী খাজা মহিউদ্দিন অবস্থান করছিলেন। কলেজ টিলা হোস্টেলে আশ্রয় নিয়ে আমার পুত্র পলাশকে হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কয়েকদিন চিকিৎসার পর সে মৃত্যুবরণ করে। সেটা ছিল আমার জন্য নিদারূন কষ্টের ব্যাপার। সেই গভীর কষ্ট বুকে নিয়েই আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করি।  

 

কলেজ টিলা হোস্টেলে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা আমাকে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হতে বলেন। এরপর আমি সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাংলাদেশ থেকে যারা যেতেন তাদের নাম রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ব পালন করতে থাকি। সূর্যমনিনগর ক্যাম্প, গোকুলনগর ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে  আমাকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, রিলিফ বিতরণ, চিকিৎসা সেবা দেয়া, স্কুল পরিচালনাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে হয়।

 

এরপর আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাকে প্রশিক্ষণের জন্য গোকুলনগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে মেজর হায়দার ও মেজর খালেদ মোশারফসহ কয়েকজন সামরিক অফিসার আমাদের কয়েকজন মহিলাকে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দেন। তাদের কাছে অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার পরে আমি নিজে আরো ২৯ জন মহিলাকে একই ধরনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। এ জন্য তখন আমাকে কমান্ডার ফরিদা বলেও ডাকা হতো।

 

অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আমি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যে, তখন নারী হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে না পারার হতাশা নিয়েই পরে অন্য কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করি। পরে যুদ্ধে আহত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য নার্সিং স্কোয়াড গঠন করা হলে সেখানে আবার প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহন করি। এজন্য আমাকে আগরতলা শহরের জিবি হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ফিল্ড হাসপাতালে  ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হতো। এই সময় আমার সঙ্গে নার্সিং স্কোয়াডে আরও ৬০ জন মহিলা যোগ দিয়েছিলেন।

 

একবার আমেরিকা থেকে রবার্ট কেনেডি ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন। এসময় কেনেডিকে হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে আমি নার্সিং ট্রেনিং দেয়া মহিলাদের আগরতলায় পাঠাই। এছাড়াও আমি স্থানীয় এমপি দশরথ দেব ও জেলা প্রশাসক সাবেক শিং-এর সাথে রিলিফ সংক্রান্ত সমন্বয়ের কাজে সহযোগিতা পালন করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মহিলাদের নিয়ে তখন আমি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। সেই সংগঠনটি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ মহিলা সংঘ’ নামে দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। আমি এখনো মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা সংঘ সংগঠনটি পরিচালনা করছি। এটাও আমার জন্য একটি গৌরবের ব্যাপার যে, মুক্তিযুদ্ধকালে যে সংগঠনটি আমি গঠন করেছিলাম এখনো সেটির নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছি।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর