শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

রাজাকার হত্যা করতে গিয়ে ভুলক্রমে স্টেনগানের গুলিতে সহযোদ্ধা আহত

বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভূঁইয়া জুলহাস

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভূঁইয়া জুলহাসের লেখা মুক্তিযুদ্ধে একটি অপারেশনের কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভূঁইয়া জুলহাস : মুক্তিযুদ্ধকালে এক রাজাকারকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলক্রমে আমাদের এক সহযোদ্ধার পায়ে স্টেনগানের গুলিবিদ্ধ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সে গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে তাকে অপারেশন স্থান থেকে কাধে করে সরিয়ে নিয়ে আসি। এমনটা হবে আমরা ভাবতেই পারিনি কিন্তু আমাদের অসাবধানতার জন্য এই ঘটনা ঘটে যায়। পরে  সে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে ওঠে এবং পরে অন্য অপারেশনেও আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পরও সেই ঘটনা আমি ভুলতে পারিনি। এখনো সেই ঘটনা মনে হলে ভয়-আতংকে গা শিউরে উঠে। সেদিন আরেকটু ভুল হলেই আমাদের সেই  সহযোদ্ধা শহীদ হয়ে যেতেন। ৭১ সালে আমি গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতাম। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপরই চারিদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

 

আমি তখন বয়সে কিশোর হলেও পাকিস্তানিদের গণহত্যা আমার মনে চরম প্রভাব ফেলে এবং আমি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কি করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। আমাদের বাড়ির পাশে চাচা সম্পর্কে আব্দুল বারেক বয়সে আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় হলেও বন্ধুর মতো একসাথে চলাফেরা করতাম। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আগরতলা যাব।

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা দুই বন্ধু নিজেদের বাড়ি থেকে ধান-চাল চুরি করে বাজারে বিক্রি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করি। আমি বাড়ি থেকে ধান নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে পারলেও আমার বন্ধু বারেক ভুইয়া বাড়ি থেকে চাল বের করে বিক্রি করার সুযোগ পায়নি। ফলে সে টাকার অভাবে আগরতলা যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দেয়। আমি ধান বেচার টাকা নিয়ে একাই আগরতলার দিকে রওনা হয়ে যাই। আমি বাড়ি থেকে প্রথম যাই বৈদ্দের বাজার লঞ্চঘাটে। সেখান থেকে লঞ্চে চড়ে রামকৃষ্ণপুর যাই। রামকৃষ্ণপুর যাওয়ার পথে লঞ্চে এক যুবকের সাথে পরিচয় হয়, সে নারায়ণগঞ্জে একটি টেক্সটাইল মিলে কাজ করতো। সেই যুবক রামকৃষ্ণপুর নেমে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এক রাতের জন্য আশ্রয় দেয়। সেই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরে আমি আগরতলার উদ্দেশ্যে আবার রওনা হই।

 

সেই যুবক আমাকে কিভাবে ভারতে যেতে হবে তা বুঝিয়ে দেয়। তার পরামর্শ অনুযায়ী আমি কখনো কখনো হেঁটে কখনো নৌকায় চড়ে ত্রিপুরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। এরপর বক্সনগর সীমান্ত দিয়ে আমি ত্রিপুরায় প্রবেশ করি। ত্রিপুরায় প্রবেশ করে আমি সরাসরি আগরতলায় কলেজ টিলা ক্যাম্পে যাই। কলেজ টিলার ক্যাম্প থেকে পরে যাই হাঁপানিয়া ক্যাম্পে। হাঁপানিয়া ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক আগেই অবস্থান করছিলেন। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। হাপানিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। পরে  আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য মেলাঘর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে আমরা ২০/২২ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখানে আমাদের অস্ত্র কিভাবে চালাতে হবে, কিভাবে অস্ত্র বহন করতে হবে এবং কোন স্থাপনায় বোমা ফিট করে কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে সেইসব প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

 

অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের ইসমাইল কমান্ডারের গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে দেশে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমাদের গ্রুপকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আমরা ইসমাইল কমান্ডারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবেশ করে সরাসরি আমাদের এলাকায় চলে আসি। এলাকায় ফিরে আমরা বিভিন্ন অপারেশন করার পরিকল্পনা করতে থাকি। একপর্যায়ে এলাকার এক রাজাকারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। সে অপারেশন করার জন্য আমার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বারেক ভূইয়া এবং তোতা গাজীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর মাসে মাঝামাঝিতে।

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সেই রাজাকারের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য কয়েকদিন সেই এলাকায় রেকি করি। সেই রাজাকার রাতে তার বাড়িতে না থেকে অন্যত্র অবস্থান করতো। আমরা কয়েকদিন রেকি করার পর একদিন খবর পাই যে সে একটি চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। এই খবর পেয়ে আমরা সাথে সাথে একটা স্টেনগান এবং কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে সেই এলাকায যাই। আমরা তিনজন স্টেনগান ও গ্রেনেড নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাদের দেখেই সে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমরা তখনই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

 

আমাদের সহযোদ্ধা বারেক তার স্টেটগান সেই রাজাকারীর দিকে তাক করে ব্রাশফায়ার করে। রাজাকারের গায়ে গুলী লাগার পর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল গুলিতে তাকে হত্যা করতে না পারলে আমি গ্রেনেড চার্জ করব। কিন্তু বারেকের স্টেনগানের গুলিতে সেই রাজাকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ায় আমাকে আর গ্রেনেড চার্জ করতে হয়নি। একই সময় আমাদের আরেক সহযোদ্ধা তোতাগাজি বেয়নেট দিয়ে সেই রাজাকারকে আঘাত  করে। কিন্তু এ সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ভুলক্রমে স্টেনগান থেকে একটি গুলী বেরিয়ে যায় এবং সে গুলী গিয়ে তোতাগাজীর পায়ে আঘাত করে। সে গুরুতর আহত হয়ে পড়ে যায়। এ ঘটনা ঘটার পর আমরাও ভয় পেয়ে যাই। এখন যদি তোতাগাজীকে নিয়ে এখান থেকে সরে যেতে না পারি তবে হয়তো পাকিস্তানিরা এখানে এসে আমাদের হত্যা করতে পারে। এই ভয়ে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়।

 

আমি কোনমতে তোতা গাজীকে টেনে কাছাকাছি একটি নির্জন নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হই। তোতা গাজীর জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা হয়। আমি একটি গামছার মতো একটি কাপড় দিয়ে তার ক্ষতস্থান শক্ত করে বেধে দেই। এরপর আরো দুইজন লোকের সহযোগিতায় আমরা তাড়াতাড়ি গাজীকে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে লক্ষণখোলায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমার ক্লাসমেট হাসেমের বাড়িতে গিয়ে উঠি। সেখানে তোতাগাজির চিকিৎসার জন্য লুকিয়ে একজন ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়। ডাক্তার এসে ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেন। এরপর আমরা প্রায় ১৫ দিন আর নিজের এলাকায় আসিনি, লক্ষনখোলার সেই বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম। ১৫ দিন পর তোতাগাজী মোটামুটি সুস্থ্য হওয়ার পর আমরা এলাকায় ফিরে এসে আবার নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা করতে থাকি।

এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর