সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

রেল ক্রসিং-এ মানুষ হত্যা

করীম রেজা

প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২২  

 


বেঘোরে প্রাণ গেল গতকাল ১১ জনের। অন্যদিকে আহত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বড় তাকিয়া স্টেশন এলাকায় গত শুক্রবার দুপুর দেড়টায় এ ঘটনা ঘটে । প্রথম আলো পত্রিকা বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে যে, শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। রেললাইনের আগে কোন প্রতিবন্ধক বা সংকেতের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি গেটম্যানও অনুপস্থিত ছিল। তাই কোনো বাধা না পেয়ে, গাড়ি না থামিয়ে, মাইক্রোবাসের চালক গাড়ি চালাতে থাকে। 


বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসের চালক রেল লাইনের উপর গাড়ি নিয়ে উঠে পড়ে। সেই মুহূর্তে ছুটে আসা রেলগাড়ি ধাক্কা দিয়ে এক কিলোমিটার এর মত দূরে ঠেলে নিয়ে যায় মাইক্রোবাস। এতে মাইক্রোবাসেই ১১ জন মারা যায়। এটাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যা বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। সড়ক ব্যবস্থাপনায় উদাসীনতা, অবহেলা আর অরাজকতার কারণে এমন হত্যাকান্ড প্রায় নিয়মিত হচ্ছে দেশের এখানে সেখানে। বড়তাকিয়া এলাকায় ছাত্র-শিক্ষকের আনন্দ শোভাযাত্রা মুহূর্তেই শব যাত্রায় পরিণত হয়। ১১ জনের ভয়ানক মৃত্যু চিহ্ন দীর্ঘ এক কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর দায় কি কারো নেই? এই জিজ্ঞাসা ওই পথের, পথের পাশে ছড়িয়ে থাকা জামা-জুতার, দেখতে আসা মানুষের। পরিবারের কথা বাদই রাখা যায়, কেননা যার যায় শুধু সে-ই বোঝে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী প্রভাতী ট্রেন মাইক্রোবাসটি ধাক্কা দেয়। দায়িতে ¡অবহেলার অভিযোগে গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গেটম্যানকে দায়ী করে মামলা হয়েছে। দুই দুইখান তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই জাতীয় ঘটনায় সচরাচর এমনই হয়। বলা হয়েছে তিন দিনের মধ্যে এই তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। 


চট্টগ্রাম রেল বিভাগের একজন দায়িত্ব কর্মকর্তা দাবি করেন দুর্ঘটনার পর সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে যায়নি। সাদ্দামের দাবী সে প্রতিবন্ধক নামিয়ে যানবাহন আটকে দিয়েছিল। কিন্তু মাইক্রোবাসটি যাওয়ার জন্য কেউ একজন প্রতিবন্ধক তুলে দেয়। আর তাতেই এই মৃত্যু। তার মানে সে নির্দোষ, দোষ যারা মারা গেছে তাদের। অন্যদিকে আহতদের একজন সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছে গেটম্যান বলে কেউ ছিল না। কোন প্রতিবন্ধক দন্ডও নামানো ছিল না। সেই অবস্থায় মাইক্রোবাসের চালক গাড়ি চালিয়ে রেললাইনের উপর উঠে পড়ে। এই আহত যাত্রী মাইক্রোবাসের সব থেকে পেছনের সিটে বসেছিল, তাই কম আঘাত পেয়েছে। বিস্তারিত জানতে অপেক্ষা করতে হবে তদন্ত কমিটির রিপোর্টের। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, একজন কর্মকর্তা যিনি একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি জানিয়েছেন প্রায় সব প্রতিবেদনের ভাষা, সুপারিশ ও দায়ী করার পদ্ধতি একই রকম। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায় যানবাহন চালকের উপর দেয়া হয়। গেটম্যানের অবহেলা থাকলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তবে লোকবল সংকটের কারণে কিছুদিন পর তাকে আবার দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয়।


সড়কে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও রেল ক্রসিং এ প্রাণহানির দায়ে কোন শাস্তি দেয়ার বিধান নাই। তাছাড়া রেলওয়ে বিভাগের দুর্ঘটনার সংজ্ঞাও ভিন্নরকম। রেললাইনে কাটা পড়ে যারা মারা যায় তাদের হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ যেমন রাখে না, তেমনি তাদের মৃত্যুকে দুর্ঘটনার সংজ্ঞাতেও বিবেচনা করা হয় না। শুধুমাত্র মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, পরস্পর ট্রেনের ধাক্কা দেয়া, রেল ক্রসিং-এ ট্রেনের গাড়ি চাপা দেয়া, এসবই কেবলমাত্র রেলওয়ে আইনে দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। জানা যায় রেলের হিসাব মতে ২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৭ বৎসরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২২১ জন। তার মধ্যে ১৮৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন রেল ক্রসিং-এ। সারাদেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিং অরক্ষিত, বাকি ১৮% ক্রসিং এ পাহারাদার এবং প্রতিবন্ধক দুটো থাকলেও প্রায়ই পাহারাদারের অবহেলা কিংবা অসাবধানতার কারণে নিয়মিত দূর্ঘটনা ঘটছে। রেলওয়ে তথ্য মতে সারাদেশে মোট রেল ক্রসিং এর সংখ্যা ২৫৬১টি। অনুমোদন নেই ১৩২১ টির। এই অনুমোদন ছাড়া ক্রসিংয়ের বেশিরভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত সড়কে অবস্থিত। তাছাড়া আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তায়ও। এসব রেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় আছে। 


রেলওয়ে বিভাগের অরক্ষিত আর সুরক্ষিত বিভাজনের মধ্যেও আছে বিচিত্র বিচার, বিবেচনা, বিধি এবং সর্বোপরি সমন্বয়হীনতা। নতুন রেললাইন তৈরি হওয়ার পরে প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর উপর দিয়ে কোন সড়ক নির্মিত হলে, সেই সড়কই শুধু সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেল বিভাগের। অন্য কোনও পক্ষ রাস্তা নির্মাণ করলে তা রেল বিভাগকে জানাতে হবে। কিন্তু সড়কের কারণে তৈরি রেল ক্রসিং-এ পাহারাদার ইত্যাদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব¡ সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। এটা করা না হলে রেলওয়ে বিভাগ অনুমোদন নাই বলে ঐসব রেল ক্রসিং তালিকাভুক্ত করে তাদের দায় দায়িত্ব শেষ করে। পুরনো ধ্যান ধারণা, অবাস্তব, সময়ের সঙ্গে অনুপযোগী আইন কানুন পরিবর্তনের কোন উদযোগ নেয়া হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত জানা যায় না। দেখা যায় না দীর্ঘদিন যাবত অবহেলিতভাবে পড়ে থাকা, রেলের ভাষায় অনুমোদনবিহীন ১৩২১টি রেল ক্রসিং এ নিরাপত্তা বিধানের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই সমস্ত মানুষ হত্যার জায়গাগুলো উন্মুক্ত, অরক্ষিত রেখে রেলওয়ে এবং সড়ক জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন কেউই দায়মুক্ত হতে পারেনা। দশ বছরে রেলের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তারপরও শত শত রেলক্রসিং অরক্ষিত,দেয়া হয়নি নতুন নিয়োগ,করা হয়নি নিরাপত্তা আধুনিকায়ন। রেল ক্রসিং-এ এই সকল কথিত দুর্ঘটনা মূলত সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলোর অবহেলা জনিত হত্যা। আইনের নানা রকম ফাক ফোঁকর দেখিয়ে দুর্ঘটনা বলে চালানো হচ্ছে। দেশের কর্তা ব্যক্তিরা,নীতি নির্ধারক, সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত আমলাগন, সাধারণ মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন নিরাপদ করার কোন সক্রিয় উদ্যোগে আগ্রহী নয়। হলে এতদিনে অবস্থার প্রভূত উন্নতি হতো। এত মৃত্যু দেখতে হতো না।


রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, অরক্ষিত ক্রসিং-এ ট্রেন এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘণ্টা বাজার ব্যবস্থা চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। এখনও 'তাহারা' পরিকল্পনা গ্রহনই দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ কর্তব্য বলে জানাচ্ছেন। সারা বিশ্বে রেল ব্যবস্থা নিরাপদ পরিবহন রূপে বিবেচনা করা হয়। রেলের বহুবিধ উন্নয়ন ঘটেছে সারা দুনিয়া জুড়ে। বাংলাদেশের রেল বিভাগ আজও পর্যন্ত যাত্রী সেবা নিরাপদ ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি,করেনি। রেল ক্রসিং এ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘণ্টা বাজার ব্যবস্থা,তাৎক্ষণিকভাবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ফ্লাশিং লাইট ব্যবহার করা, তাছাড়া ক্রসিং এর দুই দিকে কমপক্ষে তিনটি করে ছয়টি গতিরোধক বসানো, এসব দরকারি কাজগুলো কেউ করার অগ্রাধিকার গুরুত্ব অনুধাবন করেনি। নানারকম প্রকল্প গৃহীত হয়। যেমন সেতু আছে,রাস্তা নাই। সেতুতে ওঠার এপ্রোচ সড়ক নাই। বিলের মধ্যে স্থাপনা। খালে পানি নেই কিন্তু সেতু নির্মাণ চলছে বা হয়েছে। সাধারণ মানুষের পথচলা অবাধ না করে, চলতি পথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুন্নত রেখে, নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যে কোন সরকারি বিভাগের সর্বপ্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। 


রেলওয়ে বিভাগে প্রায় ২২৭০৪টি পদ খালি, সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে মন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন। তার মধ্যে ৩য় শ্রেণির ৮৫৭৫ টি এবং ৪র্থ শ্রেণির ১২৩২৭ টি পদ খালি। অহরহই বলা হয়, অজুহাত তোলা হয়, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে কোনও কাজই ঠিকমত করা যায় না। বছরের পর বছর এ সব পদে লোক নিয়োগ করা হয় না। মন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন, শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একদিকে মানুষের অপঘাতে অকাল মৃত্যু, অন্যদিকে দপ্তর, অধিদপ্তর, সচিবালয়, মন্ত্রণালয় প্রভৃতি আইনের বেড়াজালে শূন্য পদে নিয়োগ বন্ধ রেখে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত করা। এই সব হত্যা-মৃত্যুর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। দিনে দিনে এই দাবি আরো জোরালো হবে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে দেখা যায়, খোঁড়াযুক্তিতে দায় এড়ানো হয়, অর্থাৎ এড়ানো মানেই মৃত্যু বাড়ানো। সবদিক বিবেচনা করে সময়োচিত, উপযোগী সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকরের মাধ্যমেই অকালে অপ্রত্যাশিত অপঘাতে হত্যা-মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সুমতি হোক।এমই/জেসি


 

এই বিভাগের আরো খবর