বৃহস্পতিবার   ১২ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২৭ ১৪৩১

লক্ষ্যার মরণদশা রুখবে কে?

ফরিদ আহমেদ রবি

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০২৪  



নারায়ণগঞ্জের প্রাণ ক্ষ্যাত, একদা স্বচ্ছ সলীলা শীতলক্ষ্যা নানাবিধ কারণে আজ মরণদশায় উপনীত।এই ধারা অব্যাহত থাকলে অস্তিত্ব হারিয়ে নদীটির নর্দমায় পরিণত হওয়া সময়ের ব্যপার মাত্র।৩, ডিসেম্বর নির্মীয়মান নতুন টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন নৌ পরিবহন,শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন।এ সময় পরিবেশবাদীদের প্রশ্নের মুখে পড়েন উপদেষ্টা মহোদয়।

 

 

নদী পাড়ের অসংখ্য গাছ কেটে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে যার ফলে নদী সংকীর্ণ এবং পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে মর্মে পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেন।যেহেতু প্রকল্পের কাজ অনেকটা সম্পন্ন হয়ে গেছে তাই এটি সম্পন্ন করতে হবে তবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৃক্ষ রোপনের আশ্বাস প্রদান করেন উপদেষ্টা মহোদয়।

 

 

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে গত মাসের ১৩ তারিখ নারায়ণগঞ্জ এসে জনাব সাখাওয়াত তলদেশের বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে নদী দূষণ রোধ এবং দুই তীরের সৌন্দর্য বর্ধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।দুটি ক্ষেত্রেই শীতলক্ষ্যা নদীর হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনার ঘোষণা রয়েছে।এমন ঘোষণায় আনন্দিত হওয়ার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে নারায়ণগঞ্জবাসী তেমনভাব আশ্বস্ত হতে পারছে না।

 

 

এর কারণ আর কিছুই নয় এমন বহু আশ্বাস তারা এর আগেও পেয়েছে।বৃক্ষরোপন,নদীতীর সংরক্ষণ,ওয়াকওয়ে নির্মান প্রভৃতি কাজও বেশ কিছু অঞ্চলে সম্পন্ন হয়েছে,কিছু অঞ্চলে চলমান রয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যা, নদী দূষণ রয়েই গেছে, তাই এসব কাজের কাংখিত সুবিধা আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন উপদেস্টা মহোদয়ের আশ্বাস বানী বাস্তবে রূপ নিলেও তেমন কোন লাভ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না নদী দূষণ এবং সংকীর্ণ করণের মূল ঊৎস চিহিৃত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 


নারায়ণগঞ্জের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে বেড়ে ওঠা প্রায় প্রতিটি মানুষই বিভিন্ন কারণে নদীটির প্রতি ভীষণ দুর্বল।চরিত্রগত বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্যই নারায়ণগঞ্জের উভয় পাড়ের মানুষের কাছে শীতলক্ষ্যার এ অবস্থান,যা পুরোপুরি স্মৃতিতে পরিণত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র! শীতলক্ষ্যা তার সব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দুর্গন্ধময় নর্দমায় পরিণত হয়েছে।কেবলমাত্র নৌ পরিবহন ব্যবস্থাটুকু টিকে রয়েছে, নৌবন্দর সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্হাপনার কারণে।

 

 

আদালতের নির্দেশে উভয় পাড়ে নদীর সীমানা আগেই চিহ্নিত হয়েছে। নদীতীরে জন সাধারণের চলাচল এবং অবস্থান স্বস্তিদায়ক করতে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।এই কাজ একসময় শেষ হবে কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই কর্মযজ্ঞ, তা কতটা সফল হবে, তাই প্রশ্ন।অপরিকল্পিত নগরায়ন,শিল্পায়ন, নদী তীর দখল প্রভৃতি কারণে শীতলক্ষ্যা পরিণত হয়েছে দুর্গন্ধময় তরল বর্জ্যের সংকীর্ণ নালাায়। একসময় শীতলক্ষ্যা ছিল স্বচ্ছ, সুপেয় পানির জন্য জগত বিখ্যাত।সে অবস্থান হারিয়ে নদীটি এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ভুগছে।

 


শিল্প বানিজ্যে সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও সারা দেশে এক বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ছিল ।শিল্প বাণিজ্য আগের ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে এখনো ধারাবাহিকভাবে সমৃদ্ধির পথেই এগিয়ে চলেছে। নদীর দুই পাড়ে ব্যবসা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি স্বত্বেও নান্দনিক সৌন্দর্যের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত ছিল নদী কেন্দ্রিক নারায়ণগঞ্জ।

 

 

নদীর দুই পাড়ে যেমন ছিল শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তেমনি ছিল সবুজের সমারোহ।পরিবেশ বান্ধব পাট ব্যবসা এবং শিল্প কেন্দ্রগুলো ছিল বড় বড় মাঠ, পুকুর এবং অসংখ্য বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ।যে কারণে শিল্প ঘন একটি শহরে বাস করেও কোন রকম শিল্প দূষণের মুখোমুখি হতে হয়নি।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সে অবস্থান আর নেই বললেই চলে।অপরিকল্পিত নগরায়ন,শিল্পায়ন,নদী দখল।

 

 

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এবং বর্জ্য দূষণ জনিত কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর সমূহের একটি হিসেবেও নারায়ণগঞ্জের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে।নারায়ণগঞ্জ শহর দিনে দিনে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।পুরোপুরি অযোগ্য হওয়া সময়ের ব্যপার মাত্র।জাতীয় অর্থনীতিতে একক জেলা হিসেবে নারায়ণগঞ্জের অবদান সর্বোচ্চ হলেও পরিবেশ দূষণ রোধে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি।

 

 

তবে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ধারা ঠিকই অব্যাহত আছে। শিল্প খাতের উন্নয়ন যত হচ্ছে, ততই বাড়ছে পরিবেশ দূষণ।আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত।একসময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওষুধ শিল্পে ব্যবহারের জন্য শীতলক্ষ্যার পানি জাহাজে ভরে নিয়ে যাওয়া হতো।

 

 

লক্ষ্যাপাড়ের লোকজন দৈনন্দিন প্রয়োজনে শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহার করতো। নদীর উভয় পাড়েই স্নানরত নারী পুরুষের ভিড় ছিল দর্শনীয়। কলস কাঁখে মা-বোনদের পানি সংগ্রহের দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। একশ্রেণীর লোকের বিশ্বাস ছিল,শীতলক্ষ্যায় স্নান করলে অনেক ধরনের রোগ সেরে যায়। সেই আশায় দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই শীতলক্ষ্যায় স্নানের উদ্দেশ্যে আসতো। সেই শীতলক্ষ্যার পানি পান করা বা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়াই দুষ্কর।

 


উপদেস্টা মহোদয়ের ঘোষণায় শীতলক্ষ্যা নদীকে কিছুটা হলেও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আশ্বাস রয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে শুধু এলাকাবাসী নয় সারাদেশই উপকৃত হবে, যেহেতু এটি দেশের প্রধান নদী বন্দর, সেই সাথে সবচেয়ে শিল্পঘন অঞ্চল।তাঁর ঘোষণা বাস্তবে রূপ নিক মনে প্রাণে এমনটিই চায় এলাকাবাসী। নদীতীরে শুধু গাছ লাগিয়ে আর নদীর তলদেশ বর্জ্যমুক্ত করে সে অবস্হানে পুরোপুরি যাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

 

 

স্হায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ মহলের পরামর্শ অনুযায়ী সমন্বিত,কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি।নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা শীতলক্ষ্যা নদী দূষণমুক্ত হোক,দখলমুক্ত হয়ে প্রসস্ত হোক যা নৌচলাচল নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন করবে। শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ বাসী এযাবতকাল শুধু আশ্বাস বানীই শুনে এসেছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

 

 

শুধু আশ্বাস নয়,কার্যকর, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের আশায় দিন গুনছে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি নারায়ণগঞ্জ বাসী। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ নারায়ণগঞ্জ বাসীর এমন যৌক্তিক দাবি পূরণে এগিয়ে আসবেন এমনটিই প্রত্যাশা। লেখকঃ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা।     এন. হুসেইন রনী  /জেসি