রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

লাগামহীন ওষুধের বাজারে রোগীদের দুর্ভোগ

আবু সুফিয়ান

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২  

 

# দাম নিয়ে বাড়ছে ক্রেতা-বিক্রেতার বাকবিতণ্ডা

 

নিত্যপণ্যের পাশাপাশি দফায় দফায় বাড়ছে ওষুধের দাম। নারায়ণগঞ্জে নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের বাজার। প্যাকেটে খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই দামে বিক্রি হয় না। ওষুধ বিক্রেতাদের নানা অজুহাতে বাধ্য হয়েই রোগীরা ওষুধ কিনছেন বাড়তি দামে। কেউ কেউ আবার ওষুধ কিনতে এসে সবগুলো ওষুধ কিনতে না পারায় কিছু কিনে বা শূন্য হাতে ফিরছেন বাড়িতে। লাগামহীন ভাবে ওষুধের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। যার কারনে অধিকাংশ রোগীদের বাধ্য হয়েই রোগ পুষে রাখতে হচ্ছে।

 

রোগ পুষে রাখায় বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর হার। আর লাগামহীন ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে দীর্ঘমেয়াদে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা। নারায়ণগঞ্জের পাইকারি ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওষুধের এরকম অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করার কোনো যৌক্তিকতা নাই। তাদের অভিযোগ, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। কালির বাজার এলাকার কয়েকটি ফার্মেসি দোকানদার বলেন, বছরে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওষুধের দাম বাড়ায় বিভিন্ন কোম্পানি। তবে তারা দাম বাড়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আমাদের বলে না, শুধু বলে দাম বেড়েছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে তাদের নির্ধারিত রেটেই আমাদের ওষুধ কিনতে হয়। বেশি দামেই ওষুধ বিক্রি করতে হয়।

 

এ দিকে নারায়ণগঞ্জের এবং বিসিক শিল্পাঞ্চলের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করলে তারা জানায়, যে ভাবে দিন দিন ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বে। কেননা বড় ব্যবসায়ীরা ইনভেস্ট করতে পারলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পূঁজির অভাবে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার অনেকেই পরিকল্পনা করছেন। পঞ্চবটির এক ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা মরিয়ম জানান, গত মাসে আমার শাশুড়ির জন্য ১৫ দিনের ওষুধ নিয়েছিলাম ২৫০০ টাকায়। আর এই মাসে এসে একই ওষুধ নিলাম ২৮০০ টাকায়। বাড়তি দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে দোকানদার বললেন যে দাম বেড়েছে তাই আমাদেরকেও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

 

মরিয়ম আরো জানান, ওষুধ না কিনে তো উপায় নেই। ওষুধ না খেলে তো আর রোগ সারবে না। তাইতো বাধ্য হয়েই ওষুধ নিতে হচ্ছে বেশি দামে। বিসিক শিল্পাঞ্চলের ফার্মাসিস্ট মোঃ মমিনুল ইসলাম জানান, প্যারাসিটামল আগে ১০ টাকা পাতায় বিক্রি করতাম। দাম বাড়ার পর এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ১২ টাকায়। প্যারাসিটামল ৬০ এম এল সিরাপের আগের মূল্য ছিল ২০ টাকা এখন ৩৫ টাকা। ভিটামিন ট্যাবলেট বি১বি২বি১২ এর আগের মূল্য ছিল ৮০ টাকা, এখন ৯০ টাকা। তিনি নতুন করে একটি সার্কুলারের কথা জানান। বলেন প্রেসারের ওষুধ এমডোকল ৫ যার দাম ৫ টাকা।

 

এদিকে এনজিওলক ৫০ এবং ৫০ প্লাস এর দাম ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা হয়েছে। নতুন সার্কুলারে এ ওষুধের দাম দেয়া হয়েছে ৬ টাকা পিস। আবার এমডোকল ৫০ প্লাস ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা করা হয়েছে। যা শীঘ্রই কার্যকর হবে। তিনি আরও বলেছেন, ওষুধের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এর কারণে ফার্মেসীগুলোতে ওষুধ বিক্রি কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি ওষুধের অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান।

 

দেশে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত কী না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ক্যাব সভাপতি। বলেন, একসময়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২ শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতো। পরবর্তীতে তা কমিয়ে ১১৭টি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে তালিকার বাইরে থাকা ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর। এতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

 

গোলাম রহমান বলেন, দেশের ওষুধ শিল্পের পরিসর ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। স্বাধীনতার আগে দেশে মাত্র ২-৩ শতাংশ ওষুধ তৈরি হতো। সেসময় চাহিদা পূরণ করতে বেশিরভাগ ওষুধ আমদানি করতে হতো। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ ভাগ ওষুধ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৮২ সালে ওষুধ নীতি তৈরির পর অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। দেশে নতুন নতুন ওষুধ কারখানা স্থাপন হতে থাকে। ফলে এই শিল্পকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। এখন চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও ওষুধের বাজার বিস্তার লাভ করেছে।

 

ক্যাব সভাপতি আরও বলেন, জেনেরিক নামের যে দুই শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের ছিল, তা পুনর্বহালের দাবি জানান তিনি। একইসাথে জবাবদিহিতা ছাড়াই কোম্পানিগুলোকে ওষুধের দাম বাড়ানোর যে সুযোগ প্রত্যাহারের দাবি করেন তিনি। ক্যাবে সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে ওষুধ শিল্প বিস্তার লাভ করলেও ওষুধ তৈরির জন্য শতকরা ৯৭ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যার মধ্যে অধিকাংশ কাঁচামাল ভারত ও চীন থেকে আসে। উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকেও কিছু কাঁচামাল আসছে।

 

তবে নিম্ন আয়ের দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো যে দাম চাইছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেই দামেই বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। ফলে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে। গত কয়েক মাসে লাগামহীন দাম বেড়েছে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের। কিন্তু দামের লাগাম টেনে ধরার কোন উদ্যোগ এখনো চোখে পড়ছে না। এদিকে হঠাৎ ওষুধের মূল্য অধিক বেড়ে যাওয়া এবং স্থানভেদে দামের ব্যাপক তারতম্যের কারণে ওষুধ কিনতে যেয়ে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছেন বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এদিকে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে পরিদপ্তর থেকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর হলেও ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তা কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর