শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৪ ১৪৩১

লাঙ্গলবন্দ স্নান এবং নদের উৎপত্তির ইতিহাস

রনজিৎ মোদক

প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২৩  


লাঙ্গলবন্দ স্নান এবং নদের উৎপত্তি সম্পর্কে চমৎকার এক কাহিনী প্রচলিত আছে। হিন্দু পুরান মতে, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ভোজকোট। এ নগরীতে ঋষি জমদগ্নি তিনি সূর্যবংশীয় কন্যা রেণুকাকে পত্নী রূপে বরণ করেণ।

 

 

তাদের ঘরে আলো করে আসে পাঁচ পুত্র সন্তান। পাঁচ পুত্র সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তানের নাম রূষন্ত দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুষেণ, তৃতীয় পুত্রের নাম বসু, চতুর্থ পুত্রের নাম বিশ্বাসুর,ভগবান বিষ্ণু রূপ পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট। পূর্বজন্মের তপস্যার দ্বারা তারা ভগবান কে সন্তান পরশুরাম রূপে পেয়েছে।

 

 

এই পরশুরামই নিয়ে আসেন ব্রহ্মকুন্ড থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ। পরশুরামের জন্মকালে বিশ্বজুড়ে চলছিল মহাসঙ্কট। একদিন পরশুরামের মা রেণুকা দেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধবরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরী গণসহ)।

 

 

পদ্মমালীর রূপ এবং তাদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকা দেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে, তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে পেয়ে রেণুকা দেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান।

 

 


তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাকে হত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে জমদগ্নি তার ছেলে পরশুরাম কে আদেশ করে তার মা রেণুকার শিরঃচ্ছেদ করতে। পরশুরাম বিচলিত হয় ওঠে! সে তার পিতার আদেশ অমান্য করবে নাকি মাতৃহত্যার বোঝা বহন করবে।

 

 

উভয় সংকটে পরে যায় পরম শিবভক্ত পরশুরাম। পরশুরাম তার মায়ের কাছে যায় এবং সবকথা খুলে বলে। তার পিতা আদেশ দিয়েছে তার শিরঃচ্ছেদ করবার। পরশুরামের মা ছিলেন সত্যপরায়ণা তাই তিনি তার ছেলে পরশুকে আদেশ দিলেন সে তার পিতার আদেশ রক্ষা করুক এবং তিনি নিজে তার মস্তক ছেদকরবার জন্য প্রস্তুত করলেন। বুকে পাথর চাপা দিয়ে পরশুরাম তার মায়ের শিরঃচ্ছেদ করলেন।

 

 


পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই থাকে। অনেক চেষ্টা করেও সে কুঠার খসাতে পারেন না তিনি। মাতৃহত্যার পাপের বোঝায় পরশুরাম উন্মাদ হয়ে এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। এক পর্যায়ে পিতার কথামত পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন।

 

 


পরবর্তীতে ভগবান শিবের তপস্যা করে উনাকে সন্তুষ্ট করে তার পাপ নিবারণের রাস্তা জেনে নেন। ভগবান শিব তাকে বলেন হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতের নিচের মানস সরবরের থেকে যেই নদ তৈরী হয়েছে তাতে স্নান করলে তার পাপ ধুয়ে যাবে। যেই কথা সেই কাজ, পরশুরাম সেই নদীতে স্নান করেন এবং পাপমুক্ত হোন। আর সেই নদই হল বর্তমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র আর যেই স্থানে স্নান করেন সেটাই ছিল লাঙ্গলবন্দ আর তিথিটা ছিল চৈত্রের অষ্টমী।

 

 


পরশুরাম মনে মনে ভাবেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি।

 

 

ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানায় এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এই জন্য এই স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এই জলধারা কোমল মাটির বুক চিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তীকালে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।

 

 

আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি ব্রহ্মপুত্র নদের নামকরণ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হল ব্রহ্মার এক ছেলে অভিশপ্ত হয়ে নদ রূপ ধারণ করে ও তার নদী জীবন সার্থক এবং মানব কল্যাণে লাগানোর জন্য ভগবান শিব তাকেই বেছে নেয়। যেই নদীতে স্নান করে দশাবতারের একজন পরশুরাম পাপমুক্ত হতে পারে সেই নদীতে যদি আমরা স্নান করতে পারি তাহলে অবশ্যই পাপের বোঝা কমাতে পারব।

 

 

কিন্তু মনে থাকতে হবে অনুতপ্ততা অর্থাৎ পাপের অনুশোচনা। এই অনুশোচনা না থাকলে হাজার বছর গঙ্গায় ডুব দিলেও কোন লাভ হবে না। আমাদের উচিত মনের ময়লা দূর করে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে ক্ষমা চাওয়া এবং এই নদীতে স্নান করা। এই নিয়ে একটি কাহিনী আছে, একদিন মহাদের মা পাবর্তীকে নিয়ে ভ্রমনে করতে বের হয়েছে।

 

 

মা পাবর্তী দেখলেন অনেক মানুষের সমাগম। তখন মা পাবর্তী শিবকে প্রশ্ন করলেন কি হচ্ছে এখানে? শিব ঠাকুর বললেন, পাপ মুক্তির জন্য স্নান করছে। মা পাবর্তী বললেন সবাই কি পাপ মুক্ত হচ্ছে? শিব ঠাকুর বললেন চল একটি নাটকের মাধ্যমে তোমার উত্তর প্রদান করি। শিব ঠাকুরকে নিয়ে মা পাবর্তী ঘাটে বসে কান্নাকাটি করছে।

 

 

আর বলছে আমার স্বামী মারা গেছে আমার স্বামীর শেষ কাজের জন্য কেউ সাহায্য করেন। তবে কোন পাপী ব্যক্তি আমার স্বামীকে স্পর্শ করতে পারবে না। সবাই চিন্তায় পড়ে গেল আমরা সবাই তো স্নান করেছি, তবে মহিলা এই কথা বলছে কেন ? আমরা কি পাপ মুক্ত হই নাই।

 

 

তখন একজন পাপী ব্যক্তি তাদের দেখে দয়া হল এবং বলল মা আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, আমি স্নান করে পাপ মুক্ত হয়ে তোমার স্বামীর শেষ কাজ করতে সাহায্য করব। এই কথা বলে লোকটি স্নান করে তাদের কাছে আসলে মা পাবর্তী ও মহাদেব তাকে নিজ রূপে দেখা দিয়ে চলে গেলেন।

 

 

অর্থাৎ যা করতে হয় বিশ্বাসের সাথে করতে হয়। মহাযোগী পরশুরাম মূলত জনকল্যানার্থে কৃষির উন্নয়নে তিনি ব্রহ্মপুত্রের জলধারা নিয়ে আসেন। শাস্ত্র বলে, “সব তীর্থ বার বার, লাঙ্গলবন্দ এক বার।” এন.হুসেইন/জেসি