শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৩ ১৪৩১

শওকত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ; তদন্ত চলমান

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১ নভেম্বর ২০২২  

 

# আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা;  অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে - শওকত চেয়ারম্যন

 

বাংলা ভাষায় একটা জনপ্রিয় বাগধারা হচ্ছে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। আঙুলটা যদি হঠাৎ কলাগাছে পরিণত হয়, কলাগাছের মতো ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সেই অবস্থাকেই বোঝায়। এর মানে হচ্ছে অত্যন্ত বাড় বাড়া, অপ্রত্যাশিত ধনসম্পদ লাভ, অবিশ্বাস্য উন্নতি, হঠাৎ বড়লোক হওয়া ইত্যাদি।

 

 

আঙুলের সঙ্গে কলাগাছের কি কোনো মিল আছে? তারপরও মানুষ কেন বলে যে আঙুল ফুলে কলাগাছ? সাধারণত অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া ব্যক্তি সম্পর্কে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ কথাটা বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার করা হয়। 

 

 

এদিকে মানুষ রূপপুর প্রকল্পের বালিশ কাণ্ডের দুর্নীতি নিয়ে জেনেছে। তাছাড়া দেশের টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার হাজার কোটি টাকা দূর্নীতি করেও তার শেষ রক্ষা হয় নাই। ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগ নেতা সম্রাট, পাপিয়া সহ অনেকের দূনীর্তির খবর শুনেছে দেশের মানুষ।

 

 

এবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার এক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মে দুর্নীতির অভিযোগ দেয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে(দুদক)। ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত এর অত্যাচার ও দুর্নীতি থেকে বাচাঁর জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়ে দুদকে অভিযোগ করেছে বক্তাবলীর স্থানীয়রা।

 

 

মাস দুয়েক আগে এলাকাবাসী দুদকে এই অভিযোগ দায়ের করেন। তার রিসিভ কপি যুগের চিন্তা প্রতিবেদকের হাতে এসে পৌছায়। একই সাথে তার অনুলিপি কপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দিয়েছে বলে জানান একাধিক ব্যক্তি। দুদকের দেয়া কপিতেও তা উল্লেখ্য রয়েছে।

 

 

শওকত চেয়ারম্যান নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়দের মতে ২৫ বছর আগে শওকত চেয়ারম্যানের তেমন কিছু ছিলনা। সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদে তিনি এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন।

 

 

অভিযোগে উল্লেখ্য রয়েছে, বক্তাবলীর ঘাট টেন্ডার, ইট ভাটার বার্থিং টেন্ডার, ফেরি ঘাটসহ ইউপি র্নিবাচেন মেম্বার প্রার্থীদের থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ, তাছাড়া কমিটি বাণিজ্য সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। দুদকে দেয়া অভিযোগে উল্লেখ্য করে বক্তাবলি বাসি জানান,

 

 

ইট ভাটা প্রসঙ্গ:

মানুষের জমি কেটে ইট ভাটা মাটি নেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। আমরা বক্তাবলী এলাকার নদী বেষ্টিত এলাকার সাধারন হত দরিদ্র বেশীর ভাগ জনগোষ্ঠী কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের বক্তাবলী রহমান মুন্সির ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলীর ক্ষমতার দাপটে এলাকার জনসাধারনের কৃষি আবাদী জমির মাটি কেটে, তার নিজের ইটের ভাটায় জোরপূর্বক নিয়ে যায় এবং অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

 

 

একই সাথে আবাদী জমি ১০/১৫ ফুট গভীর করে জমিগুলিকে চিরতরে চাষাবাদের অনপুযোগী করে ফেলছে । নদীর পাড়ে জেগে উঠা চর অত্যাধুনিক ক্রেন ব্যবহার করে, মাটি কেটে ইট ভাটায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা বিক্রয় করে বাণিজ্য করছে প্রায় ৫ বছর যাবত। আর এতে করে গত ৫ বছরে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।

 

 

বি.আই.ডব্লিউ.টি এ প্রতি বছর বার্থিং এর যে টেন্ডার হয় তখন তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অন্য কাউকে সিডিউল ক্রয় করতে না দিয়ে তাতে বাধাগ্রস্থ করে এককভাবে তার লোক দিয়ে ৩ লক্ষ টাকায় বার্থিং টেন্ডার নেন। বক্তাবলী এলাকায় প্রায় ৭২টি ইট ভাটা রয়েছে। প্রতিটি ইটভাটা থেকে বার্থিং এর জন্য ২ লক্ষ টাকা নেয়া হয়। এতে মোট টাকা দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা।

 

 

এখানে সরকার প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এলাকার ৭২ টি অবৈধ ইটভাটার সভাপতি এই প্রভাবশালী শওকত চেয়ারম্যান । ক্ষমতার দাপটে ১৫ বৎসর যাবত এই পদ দখল করে আছেন এবং প্রতিটি ইট ভাটা থেকে প্রতিবছর পরিবেশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ইটভাটা চলাকালীন সময়ে ভেকু দিয়ে ইটভাটা ভাঙ্গার ভয় দেখিয়ে প্রতিটি ভাটা থেকে ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন।

 

 

আর পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা শাখায় দেয় ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা । বাকী ৬ থেকে ৭ লক্ষ টাকা তিনি নিজে আত্মসাৎ করে। এতে ৭২টি ইটভাটা থেকে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেন এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা।

 

 

দরিদ্রদের টাকা আত্মসাৎ প্রসঙ্গ:  

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, গত ১৫ বছর যাবত শওকত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকে প্রধানমন্ত্রীর মহোদয়ের বিশেষ বরাদ্ধকৃত হতদরিদ্রদের টাকা তাদেরকে না নিয়ে নিজে আত্মসাৎ করে। অন্যদিকে বক্তাবলীর তহসিল অফিসের তহশিলদারদের যোগসাজশে সাধারণ মানুষের জমি খারিজ মিউটেশন নামে বেনামে তৈরি করে; সেই জমি তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জমি দখল করে শত শত কৃষককে নিঃস্ব করেছে ।

 

 

বক্তাবলী ঘাট প্রসঙ্গ:

বক্তাবলী খেয়াঘাটের টেন্ডার প্রায় ১৫ বছর যাবত তার নিয়ন্ত্রণে চলছে। তার প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে সিডিউল কিনতে না দিয়ে তাঁর ছেলের নামে নামমাত্র টাকায় ডাক নিয়ে আসে। অথচ সবাই যদি ওপেন সিডিউল কিনতে পারতো তবে প্রতি বছর ডাক আসতো প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা। অথচ তিনি তার ছেলের নামে ৭ থেকে ১০ লক্ষ টাকায় টেন্ডার নিয়ে আসে।

 

 

এখানে সরকার প্রতিবছর রাজস্ব হারাচ্ছে ২৫ লক্ষ টাকা। এমনিভাবে ১৫ বছরে সরকারের ৩ কোটি ৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সে আত্মসাত করে আসছেন। এছাড়া বক্তাবলী ফেরিঘাট প্রায় ১০ বছর যাবত কাউকে সিডিউলই কিনতে না দিয়ে তার ক্ষমতা অপব্যবহার করে তার পিএস বাধন এন্টারপ্রাইজ এর প্রোপ্রাইটর আনোয়ারের নামে মাত্র ১৯ লক্ষ টাকা দিয়ে ডাক আনে।

 

 

অথচ ওপেন সিডিউল কিনার সুযোগ থাকলে তা ১ কোটি টাকা দাঁড়াতো। সওজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতি বছর ডাক নেওয়ার নিয়ম থাকলেও সে প্রভাবে খাটিয়ে ৩ বছরের ডাক একসাথে নিয়ে আসে। এতে করে সরকার ১০ বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।

 

 

স্থানীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়:

বক্তাবলী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড নির্বাচন এলে প্রতিটি মেম্বার প্রার্থীকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতিজনের নিকট হইতে ৪/৫ লক্ষ টাকা করে উৎকোচ নেন বলে অভিযোগে বলা হয়। কেউ টাকা দিতে না চাইলে তাদের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। ৯টি ওয়ার্ডে প্রায় ৩০ জন প্রার্থী হয়। সকলের কাছ থেকে প্রায় এক থেকে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ।  

 

 

তাছাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ নিয়ে ক্ষমতার দাপটে তাঁর ইচ্ছা মতো নেতা কমিটিতে পদ দেয়, বলে অভিযোগ উঠে। আর এমপি সাহেবের দোহাই দিয়ে পকেট কমিটি তৈরী করে। এতে প্রায় ১ কোটি টাকার উপর আত্মসাৎ করে।

 

 

জায়গা দখল প্রসঙ্গে:

বক্তাবলী খেয়াঘাটের সন্নিকটে জোরপূর্বক জায়গা দখল করে তার ছেলে হৃদয় এর নামে হৃদয় স্টীল মিলস স্থাপন করেছে। অথচ এই জায়গা তার বংশের কোন ওয়ারিশকেও বিন্দু পরিমাণ দখল দেয় নাই এবং তার পাশেই আরেকটি বালির ব্যবসা দিয়েছে, জোর পূর্বক জায়গা দখল করে। যার ফলে পরিবেশের অনেক ক্ষতি সাধান করে। এলাকায় সে তার নিজস্ব সিন্ডিকেট বাহিনী গড়ে তুলেছে।

 

 

তাদের দিয়ে সাধারণ মানুষের জমির অংশ কিনে মানুষকে হয়রানি করে এবং বিচার সালিশের নামে অন্যায়ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। সাধারন মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এছাড়া এলাকার এল.জি.ই.ডি কাজ ও ইউনিয়নের ১% কাজ তার পিএস আনোয়ারকে দিয়ে নিম্ন মানের কাজ সম্পন্ন করে সে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়।

 

 

এলাকাবাসীর মতে, এই শওকত চেয়ারম্যানের বর্তমানে ৪/৫টি বাড়ী, ৫/৬টি শিপিং জাহাজ এছাড়াও নামে বেনামে বেশ কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। তার সঠিক তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবী জানিয়ে স্থানীয়রা দুদকে অভিযোগ দেন তার বিরুদ্ধে। অথচ গত ২৫ বছর আগেও তিনি এত সম্পদের মালিক ছিলেন না। তিনি একজন সাধারন পরিবারের লোক হয়ে সাদা মাটা জীবন যাপন করতেন।

 

 

বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত জানান, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা। এই অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে।’

 

 

দুদকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ইসমত আরা জানান, ‘এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে, আমাকে যেভাবে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে; সেই ভাবে আমি তদন্ত করছি। এখনো ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয়া হয় নাই। তবে আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।’ এন.এইচ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর