বৃহস্পতিবার   ১২ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২৭ ১৪৩১

সমালোচনায় মোহাম্মদ আলী

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪  

ফতুল্লার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীক অঙ্গনে বিতর্কিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে বারবারই আলোচনা-সমালোচনায় উঠে আসেন সর্বদলীয় রাজনীতিবীদ মোহাম্মদ আলী। যিনি বিগত আওয়ামী লীগের আমলে ওসমান পরিবারের আত্মীতার সুবাদে সদর উপজেলা এলাকাসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অন্তরালে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিগত দিনে ও মোহাম্মদ আলী ও তার ভাগিনা-ভাতিজাদের ইশারায় চলতো পুরো এনায়েতনগর ও ফতুল্লা ইউনিয়ন। এদিকে পটপরিবর্তনের পরে ও কমেনি এই আলী পরিবারের প্রভাব। পূর্বের মতো এখনো পঞ্চবটিসহ এর আশপাশের এলাকা ওই আলী পরিবারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তা ছাড়া ফতুল্লার এক প্রভাবশালী বিএনপি নেতার উপরে ছায়া হয়ে বসে তার মাধ্যমে ফতুল্লা জুড়ে চালাচ্ছেন তাণ্ডব করছেন নানা ষড়যন্ত্র। এদিকে বিগত দিনে বিএনপির সাথে জড়িত থাকলে ও আওয়ামী লীগের আমলে ভিড়ে যান ওসমান শিবিরে। যার মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ, অরাজনৈতিক শ্রমিক সংগঠন,ব্যবসায়ীক সংগঠন এমন কি এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাব, সমিতির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনেও প্রার্থীদের জন্য নিয়ে বসতেন আর্শিবাদের ভান্ডার। তার আর্শিবাদ পেলে যে কোন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সহজ হয়ে যেত এমনটাই মন্তব্য করেছেন স্থানীয় রাজনৈতিক মহল। বর্তমানে তার পুরনো ও নয়া বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ফের আলোচনা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী।


গত ৮ ডিসেম্বও সন্ধ্যায় চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ১৪১ মাস উপলক্ষে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচিতে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম মোহাম্মদ আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শামীম সেলিম এবং ওসমান পরিবারের সাথে থেকে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা সেজে মোহাম্মদ আলী তাদের সহযোগিতা করেছে। তাদের সমস্ত অন্যায় অপকর্মের উপদেষ্টা হয়ে কাজ করেছে। সকল নির্বাচনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, আমরা দেখছি স্বৈরাচারের দোসর এই ব্যক্তিটি এখনও নারায়ণগঞ্জ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে রাতারাতি এরশাদের পার্টি করেছে। বিএনপির সংসদ সদস্য হয়েছে। তারপর ওসমান পরিবারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। আমরা যখন ত্বকী হত্যার বিচার চেয়েছি সে আসেনি। সে বিচার চায়নি বরং উস্কানি দিয়েছে আমাদের কিভাবে শায়েস্তা করা যায়। তিনি আরও বলেন, এই লোকটি নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করার জন্য বিভিন্ন মহলে দৌড়াদৌড়ি করছে ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসনকে বলতে চাই আপনারা খতিয়ে দেখেন। এই লোকটি ওসমান পরিবারের সবকিছু রক্ষা করছে। ওসমান পরিবারের অবৈধ অস্ত্রগুলো কোথায়? এই অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধারে প্রশাসনের তৎপরতা দেখছি না। র‌্যাবের উদ্দেশ্য বলতে চাই আপনারা অকে বড় বড় অপারেশন করেন। আজমেরী ওসমানকে তো গ্রেফতার করতে দেখলাম না? অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতার করতে দেখলাম না? আপনারা ঘৃণার পাত্র হবেন না। ত্বকী হত্যার আসামীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুন। তিনি বলেন, শামীম ওসমান সারা নারায়ণগঞ্জ জিম্মী করে রেখেছিলো। তার প্রেতাত্মারা এখনও নারায়ণগঞ্জে আছে। তার শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু শত কোটি টাকা আত্মসাত করেছে। তার নামে দুর্নীতির কোনো মামলা হয় নাই। আমার মনে হয় এখনও তার দোসররা রয়ে গেছে। রাইফেল ক্লাবের অস্ত্রগুলো এখনও উদ্ধার হয় নাই। মোহাম্মদ আলী এক সময়ে বিএনপির সদস্য ছিলেন। তিনি দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সহসভাপতি, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধরগঞ্জ) আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।


সূত্র জানিয়েছে, এই আলোচিত মেহাম্মদ আলী আশির দশকে ব্যবসায়ী নেতা থেকে এমপি হওয়ার প্রত্যাশায় জাতীয় পার্টির চেয়াম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরে জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। প্রয়াত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ তৎকালীন সময়ে স্বৈরাচারের খেতাব প্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালর ২৭ জানুয়ারী সংসদ নির্বাচলে নারায়ণগঞ্জ- ৪ আসন (ফতুল্লা- সিদ্ধিরগঞ্জ) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। সে সময় ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে মোহাম্মদ আলীর শ্লোগান থাকলেও নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম। আওয়ামীলীগের প্রার্থী ফুটবলার আশরাফ উদ্দীন আহম্মেদ চুন্নুর থেকে কম ভোট পেয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। পরে সাবেক ক্ষমতাসীন দল বিএনপিতে যোগ দেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন এই নেতা, তৎকালীন সময়ে জেলা বিএনপির সভাপতি রোকন উদ্দীন মোল্লা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামের রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়েন জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক ও সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম। উপায় না দেখে স্মরণাপন্ন হন ভাগিনা মোহাম্মদ আলীর। তৈরী হয়ে যায় বিএনপিতে যোগ দেয়ার রাস্তা। ১৯৯৫ সালে ফতুল্লা ডি আই টি মাঠে বিশাল সমাবেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে এনে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিএনপিতে যোগদান করেন তিনি। সেই মঞ্চে মোহাম্মদ আলী হাজার হাজার জনতা আর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সামনে ফতুল্লা ডিআইটি মাঠে একটি হাসপাতাল ও কলেজ নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে ফতুল্লার সাধারন মানুষের মনে কষ্ট থাকলেও কষ্ট নেই নেতাদের মনে। কারণ নেতারা তাদের হালুয়া রুটি পেতেন নিয়মিত। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর বিএনপির এক তরফা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এমপি হন মোহাম্মদ আলী। সংসদের মেয়াদ ১৭ দিনের হলেও সংসদ সদস্যের চিরস্থায়ী খেতাব অর্জন করেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে ঋন খেলাপীর দায়ে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও হয়ে উঠেন স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা।


এদিকে গত ২০১৮ সালের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপ-নির্বাচন। এতে প্রার্থী হয় ব্যবসায়ী নেতা সেলিম ওসমান যার সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর সম্পর্ক বেয়াই। ওই নির্বাচনটি ছিল ওসমান পরিবারের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু। মাঠে নামেন মোহাম্মদ আলী। সেলিম ওসমানের পক্ষে বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী যারা সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রয়াস চালিয়েছিল স্ব কারিশমায় তাদেরকে বশে আনেন মোহাম্মদ আলী। বদলে যায় ভোটের চিত্র। মোহাম্মদ আলীর হাত ধরেই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন পান সেলিম ওসমান। এদিকে আওয়ামী লীগের আমলে শুধু জাতীয় সংসদ সদস্যই নয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ছিলো তার হস্তক্ষেপ। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নিজের ভাতিজা হাবিবুর রহমান লিটনকে প্রার্থী করিয়ে জয় ছিনিয়ে আনে। এছাড়া আসন্ন সদর উপজেলার বাকী ৬টি ইউনিয়ন পরিষদের সকল প্রার্থীরাও তার আর্শিবাদে নির্বাচিত হয়েছেন। সদর উপজেলা জুড়ে মোহাম্মদ আলীর আর্শিবাদ ছিলো সে সময় ওসমান পরিবারের আর্শিবাদের সমতুল্য। সূত্র আরো জানিয়েছে, আওয়ামীলীগের আমলে এই মেহাম্মদ আলী তার সকল বার্তায় বলতেন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বর্তমানে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।


এদিকে গত (৩০ নভেম্বর) ফতুল্লা ইউনিয়ন বিএনপির জনসমাবেশে জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ¦ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তার বক্তব্যে ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা শিল্প সমৃদ্ধশালী এলাকা।আমাদের ফতুল্লায় বিএনপির মধ্যে ছিলেন এক সময় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী সাহেব। ছিলেন আমাদের বিএনপিতে।বিএনপি থেকে নির্বাচনও করেছিলেন। আমি জানি না কি কারনে তিনি বিএনপি থেকে চলে গেছেন, কি স্বার্থে বিএনপি ছেড়ে চলে গেছেন। বিএনপির যখন দুর্দিন তখন তিনি বিএনপি ছেড়ে চলে গেছেন। স্বৈরাচারী দোসরদের সাথে গিয়ে আত্মরক্ষার জন্য হতে পারে, তার ধন সম্পদ রক্ষা করার জন্য হতে পারে, নিজে সে চলে গেছেন।


তিনি বলেন, আরেকজন ব্যবসায়ী, আমার ছোট ভাই শাহআলম বিএনপিতে ছিল। আমরা খুশি ছিলাম সে বিএনপিতে ছিল। কিন্তু জানি না কেন গেলেন, বিএনপি যখন বিপদগ্রস্থ তখন তিনি বিএনপি ছেড়ে চলে গেলেন। কিসের ভয়ে নাকি কেন, আমরা জানিনা, তিনিও বিএনপি ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা চেয়েছিলাম এই দুইজন যদি বিএনপি থাকতে, বিশ্বাসঘাতকতা যদি বিএনপির সাথে না করতো, তাদেরকে নিয়ে আমরা কাজ করতাম। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই। তারা আমাদেরই সন্তান এবং বিশিষ্টজন।
 

এই বিভাগের আরো খবর