বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১২ ১৪৩১

স্মৃতির অন্তরালে বঙ্গবন্ধুর নারায়ণগঞ্জ

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তার

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২৩  


এক আনন্দ উচ্ছল, প্রাণবন্ত, চঞ্চলা-চপলা বঙ্গবন্ধুর ‘ছটফটি বেগম’ বা বঙ্গবন্ধুর ‘নারায়নী’ আজকের ফরিদা আক্তার। জাতির পিতা আজ ধরার বুকে থাকলে আমাকে দেখে হয়তো মুচকি হাসতেন-কাছে ডাকতেন। আমার সফল জীবনটা আরও সার্থক ও অপ্রাপ্তিগুলো প্রাপ্তিতে ভরে উঠতো।

 

 

আমার পিতৃতুল্য বঙ্গবন্ধুর স্নেহের ডাক; আজও হৃদয়ে আবেগের ঢেউ তোলে, সেই মমতার কথা মনে হলে নিজের অজান্তেই অশ্রু সজল হই, আবেগতাড়িত হই, হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হতে থাকে: হে মহান নেতা লও লও লও সালাম। হে পিতা আমাদের হৃদয় মাঝে তুমি আজও অমর। হে পিতা, ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের সেই অগ্নিঝরা ভাষণ; বাংলাদেশ পেয়ে যায় স্বাধীনতার আসন।

 

 

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় মঞ্চ ও মূল চালিকা শক্তি ছিলো নারায়ণগঞ্জ শহর ও এই শহরের মানুষগুলো; যা “বঙ্গবন্ধুর নারায়ণগঞ্জ”, “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” এবং “কারাগারের রোজনামচা”তে উল্লেখ রয়েছে। সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নারায়ণগঞ্জের মানুষের ভূমিকা ইতিহসে বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে।

 

 

ভাষা আন্দোলনের সেই সময়ে মর্গ্যান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীসহ বহু নারী রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভে-মিছিলে নারায়ণগঞ্জ উত্তাল হয়ে উঠলে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করে এবং শহরের খান বাহাদুর ওসমান আলীর বাড়ী ভাংচুর করে। সেসময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও তমুদ্দিন মজলিস যুক্তভাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

 

 

শিল্প সমৃদ্ধ ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, ঐতিহাসিক জনবহুল নারায়ণগঞ্জ শহর শ্রমিক অধ্যুষিত এবং রাজধানী থেকে মাত্র সতের মাইল ব্যবধান হওয়ায় সুদীর্ঘ অতীতকাল থেকে এই শহরের মানুষ রাজনৈতিক সচেতন। ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে, বঙ্গবন্ধু জেলখানায় অনশনরত।

 

 

সূত্র মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের নেতৃবৃন্দ জানতে পারেন, বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় কারাগার হতে গোপনে নারায়ণগঞ্জ আনা হবে এবং এখান থেকে জাহাজে করে ফরিদপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে।

 

 

বঙ্গবন্ধুকে যখন নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় আনা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু কৌশলে থানার নিকটে বোস কেবিন সংলগ্ন “রওশোনিয়া হোটেল”এ সামসুজ্জোহা ও বজলুর রহমানসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে মিলিত হন এবং আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছ বঙ্গবন্ধুর আমরণ অনশনের বিষয়টি অবহিত করার জন্য বলেন।

 

 

সেসময় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু আশ্বস্ত করলেন, নারায়ণগঞ্জে “২১ ফেব্রুয়ারী” হতে পূর্ণ হরতাল পালিত হবে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনতো হবেই পাশাপাশি আমরা আপনার মুক্তির দাবী নিয়েও রাজপথে সোচ্চার থাকবো। এভাবেই নারায়ণগঞ্জবাসী বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন হিসেবে, কাছের মানুষ হিসেবে, আপনজন হিসেবে তার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলো।

 

 

একইভাবে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে, ১৯৭০ এর নির্বাচনে এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ও পরবর্তী সময়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে  নারয়ণগঞ্জ শহরের মানুষের সরব উপস্থিতি ও কর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা বঙ্গবন্ধু সর্বদাই স্মরণ করতেন, কখনো তিনি তা ভুলে যাননি বরং নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষকে সবসময় কাছে টেনে নিয়েছেন।

 

 

সেসময় কালে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ফরিদপুরে যাতায়াত ছিল সহজতর। তাই স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু বহুবার নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন; গড়ে তুলেছিলেন তার কর্মীদের নিজ হাতে; আপন করেছেন এ শহরের আপামর জনসাধারণকে তার ক্যারিশম্যাটিক ব্যাক্তিত্ব ও বিচক্ষন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে।  

 

 

আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই মহান নেতাকে। আজ খুব মনে পড়ছে- বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের মিঠা পানির মাছ এবং সামসুজ্জোহা ভাইয়ের সহধর্মীণী জোহা ভাবীর রান্না খুব পছন্দ করতেন। জোহা ভাবী প্রায়শ:ই রুই-কাতলা এবং চিতল মাছ রান্না করে তার গাড়ী চালক আসগর মিয়ার সাথে আমাকে এবং তার বড় ছেলে নাসিম ওসমানকে আমার সাথী করে পাঠাতেন।

 

 

ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ীতে যতবার গিয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুর হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও তার সাথে সাক্ষাৎ শেষে ফিরতি পথ ধরব; বলতাম নেতা চলে যাই, কাজ আছে। এসময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলতেন, “ শোন শোন ‘ছটফটি বেগম’, নারায়ণগঞ্জের নারায়ণী (আমাকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর পদবী) আমার সাথে ভাত খাওয়াটাই তোর বড় কাজ। এ সুযোগ কি সবসময় পাবি?” 

 

 

আজ ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের ভাষায় বলতে হয়, “ আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি; ব্যাক্তিত্বে সাহসে, এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য।” আমি দেখেছি পিতাসম শেখ মুজিবকে, আমি দেখেছি পৃথিবীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে অনেক-অনেক কাছ থেকে। রাষ্ট্রীয় নিমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার পথে প্লেনে বসে, আগরতলার মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের গল্প বলেছি; তিনি মন্ত্র-মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনেছেন।

 

 

পিতৃতুল্য বঙ্গবন্ধুর স্নেহ দৃষ্টিতে সিক্ত হয়েছি, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার উত্তাপ অনুভব করেছি, জাতির পিতার হাসিমাখা মুখ দেখেছি, হৃৎস্পন্দন অনুভব করেছি। এ আমার পরম পাওয়া যে, প্রজন্মের পাঠকের নিকট উপস্থিত হতে পেরেছি কালের স্বাক্ষী হয়ে, ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর “নারায়ণী” রূপে।

 

 

আমার এ লেখাটি- “ বাঙালী জাতির শুকতারার ইতিহাস, আবেগজড়িত অকারণে অসত্য পরিহার করে সত্য ও সঠিক ইতিহাস” প্রজন্মের পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নিবে; এটাই আমার প্রত্যাশা। লেখক: জাতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা “বেগম রোকেয়া পদক-২০২০” প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নারী কমান্ডার ফরিদা আক্তার।

এই বিভাগের আরো খবর