বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১২ ১৪৩১

১৬ বছরে শামীম ওসমান পরিবারের চার হাজার কোটি টাকা পাচার

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :

প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০২৪  


# তাদের দেশের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানাই : রফিউর রাব্বি
# শামীম ওসমানের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বাতিল করা হোক : মাহবুবুর রহমান মাসুম
# পাচার করা অর্থ কী করে ফেরত আনা যায় দুদকের ভাবা উচিৎ : ধীমান সাহা জুয়েল

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলেও এমপি হতে পারেননি গডফাদার হিসেবে কুখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। তবে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে নানা কুকর্ম, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভূমিদস্যুতা, মাদকব্যবসাসহ তখন থেকেই বিপুল অর্থবৈভবের মালিক হন শামীম ওমান। ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর তাঁর ভাই সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি, শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু, বড় ভাইয়ের স্ত্রী পারভীন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ গোটা পরিবার হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। সূত্র জানিয়েছে, গত ১৬ বছরে প্রায় চারহাজার কোটি টাকা পাচার করেছে শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। 

 

শামীম ওসমান নানাভাবে দুবাই, মালেয়শিয়া, তুরস্ক, কানাডা এবং আমেরিকায় এই টাকাগুলো পাচার করেছেন। সেখানে বাড়ি, নাগরিকত্ব, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছুই করেছেন শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরা। সূত্র জানায়, শামীম ওসমান, তাঁর শ্যালক টিটু, ভাই সেলিম ওসমান, বড় ভাবী পারভীন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানও দুবাইয়ের আজমান বাড়ি কিনেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আজমেরী ওসমান তার স্ত্রী ও মাকে নিয়ে দুবাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। সেলিম ওসমানের বাড়ি রয়েছে মালেয়শিয়াতে। শামীম ওসমানের বাড়ি রয়েছে তুরস্ক, কানাডার টরেন্টোতে, দুবাইয়ে আজমান ও আমেরিকাতে। শামীম ওসমানের শ্যালক টিটু ৫/৬টি বাড়ি কিনেছেন আমেরিকায়। সেখানেই বর্তমানে তিনি স্ত্রী পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। শামীম ওসমানের পুরো পরিবারের বিদেশে টাকা পাচারের মধ্যে দুবাইতে পাচারের মাত্রাটি বেশি। 

 

সূত্র জানায়, পাচার করা এসব অর্থের মূল উৎস ছিল নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন সেক্টরে গোটা পরিবারের ব্যাপক চাঁদাবাজি, নৌপথে মাদক কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, জমি দখল বিক্রির ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, ইন্টারনেট, ডিস ব্যবসা, নৌপথে পণ্যপরিবহণের বেশ কয়েকটি বড় ট্যাঙ্কার জাহাজ। এসব অর্থ শামীম ওসমানের বন্ধু ব্যাংক লিয়াকত, আরেক বন্ধু সাবেক ভ্যাটের কর্মকর্তা অনুপ কুমার সাহা, শামীম ওসমানের ক্যাডার শাহনিজাম, কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলসহ আরো বেশ কয়েকজনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। সন্ত্রাসী শাহনিজামেরও দুবাইয়ে বাড়ি, মার্কেটসহ নানা ব্যবসা রয়েছে বলে জানা গেছে।

 


সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্তে এসব তথ্য বেড়িয়ে এসেছে শামীম ওসমান ছাড়াও আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও প্রবাসে সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়টি উঠে এসেছে।


যদিও, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। কিন্তু সেই তথ্য গোপন করে বিগত সরকারের টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে নির্বাচনের রাতেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে কানাডায় যান শামীম ওসমান।   তবে, এবার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর ভারত হয়ে দুবাইয়ের আজমান শহরে অবস্থান করছেন শামীম ওসমান। এমন তথ্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনকারীদের উপর প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও তার অনুসারী আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।

 

আন্দোলনকারীদের দমাতে ১৯ জুলাই দুপুরে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সড়কে নেমে আসেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। দিনভর নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের এক মাথা থেকে অন্য মাথা এবং জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কে (লিংক রোড) আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়েন শামীম ওসমান ও তার লোকজন।

 


শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের এতো বিপুল অর্থ পাচার ও দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রসঙ্গে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বাক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ওসমান পরিবারের সদস্যরা হত্যা, চাঁদাবাজি, ভূমি দস্যুতাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা করেননি। তাদের সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। বিভিন সেক্টর থেকে শামীম ওসমান যে টাকা কামিয়েছেন তা বিদেশে পাচার করেছেন। নারায়ণগঞ্জবাসীকে লুণ্ঠন করে নামে-বেনামে দেশ ও দেশের বাহিরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার বিদেশে টাকা পাচার ও বিদেশে সম্পদের বিষয়ে আমাদের অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। ওসমান পরিবারের বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনা ও দেশে থাকা তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।’

 


তিনি আরও বলেন, ‘শামীম ওসমানদের ভিওআইপি ব্যবসা, ৩০৪ কোটি আত্মসাৎ করেছে। তাদের পাঁচটা শিপ সাগরে। এসব তথ্য আমরা দুদককে বহু আগেই জানিয়েছিলাম।২০১৪ সালে এসব অনেক পত্রপত্রিকাতেও এসেছিল কিন্তু দুদক কখনই এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়নি, দুদকের অসাধু কর্মকর্তারা এমনকি এবিষয়ে তদন্তও করেনি। দুদক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। একই সাথে কানাডার নাগরিকত্ব থাকার পরও সংসদ সদস্য হওয়া সরাসরি সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড। এই ঘটনায় শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে একইসাথে এর যে অনুমোদন দিয়েছে সেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এবং দেশের বাইরে তারা যে সম্পদ গড়েছেন তা বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করারও ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

 

রফিউর রাব্বি আরো যোগ করে বলেন, ৫ আগস্টের পর ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা নারায়ণগঞ্জেই বহাল তবিয়তে আছে। এদের  অনেকেই বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেশ আরামেই আছে। এদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। 

 


মানবাধিকার কমিশন ঢাকা (দক্ষিণ) বিভাগের সমন্বয়কারী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে সাবেক সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের লুটেরাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে। দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে এখনো তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সালমান এফ রহমান, এসআলমের চেয়ে কোন অংশেই লুটপাটে পিছিয়ে ছিলনা ওসমান পরিবার। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে, বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তারা যেসব কাজ করেছে সেসব স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রদ্রোহিতা।  

 

বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিৎ তারা যেসকল দেশে টাকা পাচার করেছে সেসব দেশের সরকারকে তাদের কুকর্ম ও লুটপাটের বিষয়টি জানানো, এবং পাচার করা অর্থ -সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এতে করে যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছে বা যারা সামনে ক্ষমতায় আসবে তাদেরজন্য এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এই দাবি জানাই। আরেকটি বিষয় স্পষ্ট বলতে চাই, তারা যেহুতু বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, তাদের এদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া উচিৎ। আইনের লঙ্ঘন করে তারা যে অপরাধ করেছে সেগুলোর অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ।’


সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘যেহুতু তাঁরা গত ১৬ বছর ফ্যাসিবাদী সরকারের সুযোগ নিয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অজস্র টাকার সম্পদ বানিয়েছে, বিদেশে পাচার করেছে, এদের শক্তভাবে আইনের অন্তর্ভূক্ত করা হোক। আইনের আওতায় নিয়ে এসে দুদক কী করে এসব অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনবে সেবিষয়ে গভীরভাবে কাজ করা উচিৎ।’ 
 

এই বিভাগের আরো খবর